মাছ চাষ

প্রাকৃতিক উৎসের উন্নত মানের ব্রুড তৈরি ও ব্যবস্থাপনা

MD.AL.MAMUN | ১৬ মে ২০২৪

ব্রুড মাছ:

ব্রুড মাছ বলতে প্রাপ্ত বয়স্ক কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন প্রজননক্ষম পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে বুঝায় । প্রণোদিত প্রজননে গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ হলো হ্যাচারির প্রাণ ভোমরা । হ্যাচারিতে গুণগত পোনা উৎপাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত মানের ব্রুড মাছ।

ব্রুড মাছের বর্তমান অবস্থা

১. হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী যে পরিমাণ ও মানের ব্রুড মাছ প্রতিপালন করা প্রয়োজন তা অনেক হ্যাচারিতে করা হয় না ।

২. তাৎক্ষণিকভাবে আশ-পাশের পুকুর থেকে ব্রুড মাছ সংগ্রহ করে প্রজনন ঘটানো হয়। এ ক্ষেত্রে ব্রুডের আকার, স্বাস্থ্য, পরিপক্কতার বয়স , বংশগতি, উৎপত্তির ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনায় আনা হয় না। কেবলমাত্র স্ত্রী মাছে ডিম আছে কিনা কিংবা পুরুষ মাছে মিল্ট আছে কিনা তা দেখে প্রজননের জন্য ব্রুড মাছ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

৩. প্রতিটি হ্যাচারির ব্রুড মাছ প্রতিপালনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জলাশয় এবং আনুপাতিক হারে ব্রুড থাকা বাঞ্ছনীয় । হ্যাচারির পুকুরে যে ব্রুড মাছ প্রতিপালন করা হয় সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমিত সংখ্যক ব্রুড মাছ থেকে উৎপাদিত পোনা থেকেই সংগৃহীত হয়ে থাকে। এছাড়াও অধিকাংশ হ্যাচারি মালিকগণ একই ব্রুড মাছ বারবার প্রজনন কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এতে ব্রুডের অন্তঃপ্রজনন সহ উৎপাদনে ঋণাত্বক প্রভাব পড়ছে।

৪. বড় আকারের ব্রুড মাছের চেয়ে ছোট আকারের ব্রুড মাছের ডিমের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি ও সহজে প্রজনন করা যায় এবং রেণু উৎপাদন খরচ কম, তাই হ্যাচারির মালিকগণ তাদের ছোট ব্রুডগুলো রাখতে আগ্রহী। এতে অন্তঃপ্রজননের প্রবণতা দেখা দেয়, যার ফলে মৎস্য উৎপাদনে বিরুপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ব্রুড মাছ সংগ্রহের উৎস

ক. প্রাকৃতিক উৎস হতে রেণু সংগ্রহঃ সাধারণত প্রাকৃতির উৎস হতে সংগৃহীত রেনু থেকে ব্রুড অন্তঃপ্রজনন মুক্ত, স্বাস্থ্যবান ,দ্রুত বর্ধণশীল ও উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। সংগৃহীত প্রাকৃতিক উৎসের রেণু থেকে প্রতিপালন করা পোনা এবং সেই পোনা থেকে উৎপাদিত ব্রুড অত্যন্ত উঁচু মানের হয়ে থাকে।

খ. পুকুর হতে ব্রুড মাছ সংগ্রহঃ অন্তঃপ্রজনন মুক্ত উন্নত মানের ব্রুড মাছ হতে হ্যাচারিতে উৎপাদিত নিজস্ব পোনা বিক্রয়ের পূর্বে স্বাস্থ্যবান এবং দ্রুত বর্ধনশীল পোনা বাছাই করে ব্রুড উৎপাদন করা উচিত এবং সংগ্রহীত পোনা যেন ভাইবোন বা নিকট আত্মীয় না হয় এদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

গ.ব্রুড আদান-প্রদানঃ সরকারি এবং বেসরকারি খামার কিংবা বিভিন্ন সরকারি খামারের মধ্যে বা বেসরকারি খামার গুলোর মধ্যে ব্রুডের পারস্পরিক আদান-প্রদান (Exchange )উন্নত ব্রুড তৈরীতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনা

ব্রুড মাছের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা প্রতিপালনের উপর গুনগুতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন নির্ভরশীল । ব্রুড মাছের পুকুর সঠিক ব্যবস্থাপনার ধাপসমূহ নিম্নরুপঃ

ক. মজুদ-পূর্ব ব্যবস্থাপনা বা পুকুর প্রস্তুতি;

খ. মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা এবং

গ. মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা।

ক. মজুদ-পূর্ব ব্যবস্থাপনা বা পুকুর প্রস্তুতি

১. পুকুর নির্বাচনঃ আকারঃ০.২৫ হেক্টর হতে ০.৫ হেক্টর , পুকুরের পানির গভীরতাঃ ১.৫ থেকে ২.০০ মিটার (৫-৭ ফুট) এবং পুকুরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকা।

২. পুকুর প্রস্তুতিঃ পুকুর শুকিয়ে তলার অতিরিক্ত কাদা অপসারণ করতে হবে।

৩. চুন প্রয়োগঃ প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তবে মাটির পিএইচ জেনে চুন প্রয়োগ করা উচিত।

৪. সার প্রয়োগঃ প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুযর্তা বৃদ্ধির জন্য জৈব এবং অজৈব উভয় প্রকার সার ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। পুকুরের পানি ও মাটির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে সার প্রয়োগমাত্রা কমবেশি হতে পারে।

ক্রমিক নং

অজৈব সার

জৈব সার

 

নাম

গ্রাম/শতাংশ

নাম

প্রয়োগের পরিমাণ

১.

ইউরিয়া

১৫০-২৫০

কম্পোস্ট

২-৩ কেজি/শতাংশ

২.

টিএসপি

৭৫-১২৫

 

 

৩.

এমপি

৫০-৭৫

 

 

 

খ. মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা

১. ব্রুড মাছ পরিবহনঃ পুকুর হতে ব্রুড মাছ ধরা ও পরিবহণ কাজটি ভোরে করাই উত্তম । তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবহন ট্যাংক বা ফাইবার গ্লাসে বরফ ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. ব্রুড মাছ মজুদঃ ব্রুড মাছ মজুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত ব্রুড মাছ প্রতি হেক্টরে ১৮০০-২০০০ কেজি মজুদ করা শ্রেয়। পানি ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে ব্রুডের মজুদ ঠিক করা উচিত । বেশি ব্রুড মজুদ করলে বেশি ফল পাওয়া যাবে এই ধারণা থেকে সরে আসতে হবে।

বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মজুদ ঘনত্বের অনুপাত নিম্নরুপঃ-

ক্রমিক নং

প্রজাতির নাম

মজুদ হার

মন্তব্য

১.

সিলভার কার্প

২০%

পুকুরে মজুদকৃত পুরুষ ও স্ত্রী মাছের অনুপাত ১:১ হওয়াই বাঞ্চনীয়।

২.

কাতলা/ বিগহেড

১০%

৩.

রুই

৩৫%

৪.

মৃগেল

২৫%

৫.

গ্রাসকার্প

৫%

৬.

সরপুটি

৫%

মোট

১০০%

 

গ. মজুদ পররর্তী ব্যবস্থাপনা

১. ব্রুড মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ

প্রাকৃতিক খাদ্যঃ সাধারণভাবে প্রতি সপ্তাহে শতাংশে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ক্রমিক নং

অজৈব সার

জৈব সার

 

নাম

গ্রাম/শতাংশ

নাম

প্রয়োগের পরিমাণ

১.

ইউরিয়া

৫০-৭৫

কম্পোস্ট

১-২ কেজি/শতাংশ

২.

টিএসপি

২৫-৩৫

 

 

৩.

এমপি

১৫-২৫

 

 

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগঃ  সম্পূরক খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে এবং তা ভিটামিন, প্রোটিন , খনিজ লবণযুক্ত হতে হবে। সম্পূরক খাদ্য নিম্নলিখিত উপাদান দিয়ে তৈরি করা যেতে পারেঃ

উপাদন

মাত্রা

গমের ভূষি/চাউলের কুড়া (অটো রাইস)

৪৫%

সরিষার খৈল

৩০%

ফিশ মিল

১৫%

আটা

৫%

চিটাগুড়া

৪%

ভিটামিন ও খনিজ উপাদান

১%

মোট

১০০%

 

উপরোক্ত খাবারের সাথে এমবাভিট-এল প্রতি ১০০ কেজি ব্রুড মাছের জন্য ২৫০-৩০০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করলে ব্রুড মাছের ডিমের পরিপক্বতা ভাল হয়। এসব উপাদান একত্রে মিশিয়ে খাদ্যবল বা পিলেট আকারে খাদ্য তৈরি করে দৈনিক মাছের দৈহিক ওজনের শতকরা ৩-৪ ভাগ হারে প্রয়োগ করতে হবে।

গ্রাসকার্প ও সরপুটির জন্য দৈনিক নরম ঘাস , ক্ষুদি পানা ইত্যাদি মাছের মোট ওজনের শতকরা ২০-২৫ ভাগ দেয়া আবশ্যক।

২. সার প্রয়োগঃ পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা বজায় থাকে জন্য নিয়মিত ভাবে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

ক্রমিক নং

অজৈব সার

জৈব সার

 

নাম

গ্রাম/শতাংশ

নাম

প্রয়োগের পরিমাণ

১.

ইউরিয়া

৫০-৭৫

কম্পোস্ট

১-২ কেজি/শতাংশ

২.

টিএসপি

২৫-৩৫

 

 

৩.

এমপি

১০-১৫

 

 

 

পুকুরের পানি ও মাটির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে সার প্রয়োগমাত্রা কমবেশি হতে পারে।

৩. ব্রুড মাছের পুকুরে পানি ব্যবস্থাপনা

পানি ও মাটির গুণাগুণ ব্রুড মাছের পরিপক্বতা ত্বরান্বিত করে । পুকুরে পানি মাঝে মাঝে আংশিক পরিবর্তন করা উচিত । ব্রুড মাছের পুকুরে সম্ভব হলে মাসে এক দুই বার আংশিক পানি অপসারণ করে জীবাণুমুক্ত গভীর নলকূপের পানির ঢুকানোর ব্রবস্থা করা উচিত । পানি পরিবর্তন সম্ভব না হলে এরেটর ব্যবহার করেও ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। পিএইচ মিটার, ডিও মিটার দিয়ে পানির মান পরীক্ষা করতে হবে।

নিম্নলিখিত গুণাগুণযুক্ত পানি ব্রুড মাছের জন্য ভালঃ

ক্রমিক নং

বৈশিষ্ট্য

মান

১.

 তাপমাত্রা

২৫-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস

২.

পিএইচ

৭.৫-৮.৫৩

৩.

দ্রবীভূত অক্সিজেন

৫.৫-৬.৫ মিগ্রা/ লিটার

৪.

অ্যামোনিয়া

০.০৫ মিগ্রা/লিটার

৫.

আয়রণ

০.২০ মিগ্রা/লিটার এর কম

৬.

কার্বন-ডাই-অক্সাইড

৫-১৫ ‍মিগ্রা/লিটার

৭.

হার্ডনেস

১৫০-৪০০ মিগ্রা/লিটার

 

৪. ব্রুড মাছের রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা

সুস্থ্য-সবল রোগ-বালাই মুক্ত ব্রুড প্রজননের জন্য অত্যাবশ্যক। গুড অ্যাকোয়া কালচার প্রাকটিস অনুসরণ করতে হবে। নিয়মিত পুকুরের পানি ও মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করতে হবে  এবং চুন, সার ও সুষম খাবার সঠিক হারে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে নিয়মিত জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা সহ পুকুরে হররা টেনে দূষিত গ্যাস অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্রুড মাছ আরগুলাস দ্বারা আক্রান্ত হলে একর প্রতি পুকুরে গড়ে তিন ফুট পানি থাকলে ১০০ মিলি হারে “রিপকড” সন্ধ্যাবেলা প্রতি সপ্তাহে একবার করে তিন সপ্তাহ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া ০.৫ পিপিএম হারে ডিপটারেক্স অথবা ০.২৫ পিপিএম হারে সুমিথিয়ন ৫-৭ দিন অন্তর অন্তর তিন বার প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ব্রুড মাছ প্রতিপালনের মূল বিষয় হলোঃ

১. উন্নত জাত ও মানের ব্রুড,

২. সুষম খাদ্য,

৩. মজুদ ঘনত্ব.

৪. অক্সিজেন এর সঠিক মাত্রা এবং

৫. আর্গুলাস এর আক্রমন।