মাছ চাষ

মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

ARIFUL ISLAM | ১৬ মে ২০২৪

মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

 

মনোসেক্স তেলাপিয়া করলে চাষ

থাকব সুখে বার মাস

 

ভূমিকা

মনোসেক্স তেলাপিয়া একটি উচ্চ ফলনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল মাছ। গিফট তেলাপিয়ার এ জেনেটিক জাতটি স্থানীয় জাত বা অন্যান্য তেলাপিয়ার চেয়ে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ বেশী উৎপাদনশীল। বাণিজ্যিক চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক বিধায় বর্তমানে মনোসেক্স পুরুষ মাছের পোনার চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ৯৮-১০০ ভাগ মনোসেক্স পুরুষ মাছের পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন। এ মাছের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ

  • উচ্চ ফলনশীল
  • ৩-৪ মাসে বিক্রয়যোগ্য হয়
  • পুরুষ তেলাপিয়ার বৃদ্ধির হার স্ত্রী মাছের চেয়ে ৩০% অধিক
  • মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়া চাষ কার্যক্রমে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন বা পোনা উৎপাদিত হয় না
  • অগভীর জলাশয়সহ স্বাদু ও লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায়
  • অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন

 

মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন পদ্ধতি

বিশুদ্ধ জাতের ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও প্রতিপালন

  • ৮০-১০০ গ্রাম ওজনের গিফট তেলাপিয়ার ব্রুড সংগ্রহ করে ২০-২৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশী আয়তনের পুকুরে প্রতি শতাংশে ৭০-৮০টি হারে মজুদ করে ২-৩ মাস প্রতিপালন করতে হয়
  • মাছ মজুদ করার পর কমপক্ষে ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার মজুদকৃত মাছের মোট দেহ ওজনের ৩-৪% হারে সরবরাহ করতে হয়
  • এ মাছ সাধারণতঃ মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে

 

পুকুরে প্রজনন হাপা স্থাপন ও ডিম সংগ্রহ

  • প্রজনন হাপা স্থাপনের জন্য পুকুরের আয়তন ছোট-বড় হতে পারে। তবে ৫০-৬০ শতাংশ হলে ভাল হয়
  • এ আয়তনের একটি পুকুরে ২০মি:x৪মি:x১মি: আকারের ৮-১০টি হাপা স্থাপন করা যায়
  • প্রজনন হাপার মধ্যে প্রতি ঘন মিটারে পরিপক্ক ১৪০-২০০ গ্রাম ওজনের ৩টি স্ত্রী ও ১টি পুরুষ তেলাপিয়া মজুদ করতে হবে
  • ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য মজুদকৃত মাছের দেহের মোট ওজনের ৪-৫% হারে সপ্তাহে ৪-৫ দিন দিতে হবে
  • পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ তেলাপিয়া প্রজনন হাপায় মজুদের পর ৭ দিন অন্তর অন্তর স্ত্রী মাছের মুখ পরীক্ষা করে ডিম সংগ্রহ করতে হয়
  • স্ত্রী মাছের মুখ হতে ডিম পানি ভর্তি বালতি বা গামলাতে সংগ্রহ করতে হয়

 

ইনকিউবেশন জারে ডিম ফোটানো

  • হ্যাচারিতে সংগৃহীত ডিম প্লাস্টিকের তৈরী ইনকিউবেশন জারে (৫-৭ লিটার ধারণ ক্ষমতা) ফোটানোর জন্য রাখতে হবে
  • ৩-৪ দিনের মধ্যে ডিম হতে রেণুপোনা প্রস্ফুটিত হবে
  • এ অবস্থায় প্রস্ফুটিত রেণু পোনাকে পানি ভর্তি হ্যাচিং ট্রেতে (৪৫ সে.মি x ৩০ সে.মি.x ১২ সে.মি.) স্থানান্তর করতে হয়
  • ডিম্বথলি নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত রেণু পোনাগুলোকে হ্যাচিং ট্রেতে রাখতে হবে

 

হরমোন মিশ্রিত খাদ্য তৈরী

মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করার জন্য ৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রতি কেজি খাবারে ৫০-৬০ মিলিগ্রাম ১৭ আলফা মিথাইল টেসটোষ্টেরন (১৭- & Methyltestosterone) ১০০ মি.লি. ইথাইল এ্যালকোহলে (৯৯%) দ্রবীভূত করতে হয় অতঃপর এই দ্রবণ খাবারে ভালভাবে মিশিয়ে হরমোন খাদ্য তৈরী করা হয়।

নার্সিং হাপাতে হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি

  • হ্যাচিং ট্রে হতে রেণু পোনাগুলোকে নার্সিং হাপাতে সতর্কতার সঙ্গে মজুদ করা হয়
  • ৪০-৫০ শতাংশ আয়তনের পুকুরে ৮-১২ ঘন মিটারের ৫০-৭০টি নার্সিং হাপা করা যায়
  • প্রতিঘন মিটার হাপাতে ১,০০০-১,৫০০টি রেণু পোনা মজুদ করা যায়
  • হাপাতে রেণু পোনাগুলোকে ২১ দিন লালন-পালন করতে হবে
  • নিম্নলিখিত হারে রেণু পোনাগুলোকে হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়

পোনার বয়স

খাদ্য প্রয়োগের হার

১-৭ দিন

মজুদকৃত পোনার দেহ ওজনের ৫০%

৮-১৪ দিন

মজুদকৃত পোনার দেহ ওজনের ৩০%

১৫-২১ দিন

মজুদকৃত পোনার দেহ ওজনের ২০%

উক্ত হারে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য ভাগ করে দিনে ৪-৫ বার রেণু পোনাকে খাওয়াতে হবে।

তেলাপিয়া পোনাকে স্বাভাবিক খাদ্যে অভ্যস্থকরণ

  • ২১ দিন পর পোনাগুলোকে অন্য হাপায় (১০-১৫ ঘন মিটার) প্রতি ঘনমিটারে ৮০০-১,০০০টি হারে মজুদ করা হয়ে থাকে
  • এখানে পোনাকে দেহ ওজনের ১৫-২০% হারে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ স্বাভাবিক খাদ্য (হরমোন বিহীন) ২ সপ্তাহ সরবরাহ করতে হবে
  • এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ৯৮-১০০% মনোসেক্স পুরুষ জাতের তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করা সম্ভব

মনোসেক্স তেলাপিয়ার নার্সিং ব্যবস্থাপনা

মজুদ পুকুরে চাষের পূর্বে ছোট মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনাকে নার্সারি পুকুরে লালন করে নিতে হবে। নার্সিং না করে সরাসরি পুকুরে চাষের জন্য মজুদ করলে মৃত্যুর হার বেশী হয়ে থাকে। নিম্নে মনোসেক্স তেলাপিয়ার নার্সিং পদ্ধতির ধাপসমূহ বর্ণনা করা হলো:

নার্সারি পুকুর প্রস্ত্ততি

  • নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-২৫ শতাংশ এবং পানির গভীরতা ১ মিটার রাখা আবশ্যক
  • পুকুর শুকিয়ে সকল রাক্ষুসে মাছ ও মৎস্যভূক প্রাণী ধ্বংস করতে হবে। পুকুরের পানি সম্পূর্ণ নিষ্কাশন সম্ভব না হলে মিহি ফাঁসের জাল টেনে অথবা মৎস্য বিষ (প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম রেটেনন) প্রয়োগ করে উল্লিখিত অবাঞ্চিত প্রাণী দূর করতে হবে
  • পুকুরের পানির গুণাগুণ পোনা চাষের উপযোগী করার জন্য শতাংশ প্রতি ১.০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে
  • চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পরে প্রতি শতাংশ আয়তনে ৮-১০ কেজি গোবর অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম হারে টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে
  • পোনা মজুদের পূর্বে নার্সারি পুকুরের চারপাশে নাইলন/ফিল্টার নেটের বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে

 

নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা

  • নার্সারি পুকুরে প্রতি শতাংশ আয়তনে ১,২০০-১,৫০০টি হারে পোনা মজুদ করা যেতে পারে
  • পুকুরে প্রোটিন সমৃদ্ধ (২৮-৩০%) সম্পূরক খাদ্য নিম্নের ছক অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে

দিন

খাদ্য প্রয়োগের হার

খাদ্যের প্রকার

১-৭

৩০%

নার্সারি

৮-১৪

২৫%

নার্সারি

১৫-২১

২০%

স্টার্টার-১

২২-২৮

১৫%

স্টার্টার-১

২৯-৩৫

১২%

স্টার্টার-২

৩৬-৪২

১০%

স্টার্টার-২

 

  • প্রতি সপ্তাহে নমুনায়ন করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে
  • প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য নার্সারি পুকুরে ৭-১০ দিন অন্তর ৬-৮ কেজি পঁচা গোবর অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম হারে টিএসপি পানিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে
  • এভাবে ৬ সপ্তাহ নার্সিং করার পর পোনার আকার ১৫-২০ গ্রাম ওজনের হবে। এ সকল পোনা বিক্রি উপযোগী বা চাষের জন্য পুকুরে মুজুদ করা যেতে পারে

 

পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ

মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়া চাষ অত্যন্ত লাভজনক। স্বাদু ও লবণাক্ত পানিতে এ মাছ সহজে চাষ করা যায়। পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়া  এককভাবে চাষ করলে বেশী লাভ পাওয়া যায়। নিম্নে মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ পদ্ধতির ধাপসমূহ বর্ণনা করা হলোঃ

পুকুর প্রস্তুতি

  • পানির গভীরতা ৩-৪ ফুট থাকে এমন ছোট বড় যে কোন পুকুর মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে
  • পুকুরের পাড় মেরামত, জলজ আগাছা পরিস্কার এবং অবাঞ্ছিত মাছ দূর করে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক
  • চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হয় সার প্রয়োগের ১ সপ্তাহের মধ্যে পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে

 

পোনা মজুদ ও চাষ ব্যবস্থাপনা

  • পুকুরে প্রস্ত্ততির পর প্রতি শতাংশে ১৫-২০ গ্রাম ওজনের সুস্থ-সবল ২৫০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে
  • পোনা মজুদের পর ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য প্রতিদিন পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট দেহ ওজনের ৩-১০% হারে নিম্নের সারণী অনুসরণে প্রয়োগ করতে হবেঃ

সপ্তাহ

খাদ্য প্রয়োগের হার

খাদ্যের  প্রকার

১ম দুই সপ্তাহ

১০%

স্টার্টার-৩

২য় দুই সপ্তাহ

৮%

স্টার্টার-৩

৩য় দুই সপ্তাহ

৭%

স্টার্টার-২

৪র্থ দুই সপ্তাহ

৬%

স্টার্টার-২

৫ম দুই সপ্তাহ

৫%

স্টার্টার-১

৬ষ্ঠ দুই সপ্তাহ

৪%

স্টার্টার-১

৭ম দুই সপ্তাহ

৪%

স্টার্টার-২

৮ম দুই সপ্তাহ

৩%

স্টার্টার-২

  • পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৪-৬ কেজি গোবর সার অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করা যেতে পারে
  • প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

  • পুকুরে পোনা মজুদের ৪ মাসের মধ্যে প্রতিটি তেলাপিয়া মাছের ওজন ২০০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। এ অবস্থায় পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ আহরণ করতে হবে
  • এ পদ্ধতিতে চাষ করে এক ফসলে প্রতি একরে ৫,০০০-৬,০০০ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব

মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের আয়-ব্যয়

আধা নিবিড় ব্যবস্থাপনায় মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে এক ফসলে (৪ মাসে) এক একর জলাশয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব নিম্নে দেয়া হলোঃ

ব্যায়ের খাত

টাকা

পুকুর লিজ মূল্য

২০,০০০.০০

পুকুর সংস্কার ও প্রস্ত্ততি

২,০০০.০০

পোনা ক্রয়

৩৪,০০০.০০

সম্পূরক খাদ্য

১,৮০,০০০.০০

সার

২,০০০.০০

মাছ আহরণ ব্যয়

৪,০০০.০০

অন্যান্য ব্যয়

৮,০০০.০০

মোট

২,৫০,০০০.০০

সম্ভাব্য আয়ঃ ৫,০০০ কেজিx ৭০.০০=৩,৫০,০০০.০০

মুনাফাঃ ১,০০,০০০/- টাকা

বছরে ২টি ফসলে মুনাফাঃ ১,০০,০০০x২=২,০০,০০০/- টাকা

তেলাপিয়ার রোগ ও প্রতিকার

তেলাপিয়া একটি উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মাছ। তবে, উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে পরিত্যক্ত খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা পঁচনের ফলে পানি দূষিত হয়ে অনেক সময় রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। সাধারণত তেলাপিয়া প্রটোজোয়ান প্রারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য আক্রান্ত মাছকে ১,০০০ লিটার পানিতে ২৫-৩০ মিলিলিটার ফরমালিন মিশিয়ে ৫-১০ মিনিট গোসল করাতে হবে। অনেক সময় তেলাপিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস ও এরোমোনাড সেপটিসেমিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এরূপ হলে ১-২ গ্রাম ইরাথ্রোমাইসিন বা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রতি কেজি খাবারে মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে।