জনস্বাস্থ্য: ব্যক্তি পর্যায় হতে শুরু করে পুরো জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিষয়টিই হলো জনস্বাস্থ্য এবং ভেটেরিনারি পাবলিক হেল্থ হলো জনস্বাস্থ্যের একটি উপাদান যা মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা রক্ষা এবং উন্নতকরণে ভেটেরিনারি বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিৎ করা হয়ে থাকে।
মানবস্বাস্থ্য ও প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষায় জুনোটিক রোগ একটি বড় সমস্যা। সংক্রামক রোগের শতকরা প্রায় ৭০ (সত্তর) ভাগ রোগ পশু-পাখি থেকে মানব দেহে সংক্রামিত হয়। গবাদিপশু-পাখির উৎপাদন বৃদ্ধি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ পূর্বক একটি সুস্থ-সবল মেধাবী জাতি গঠনে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ, প্রাণিজাত পণ্য রপ্তানি এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার জুনোটিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, প্রাণিজাত খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণ, মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্যকর সহ-অবস্থান এবং মানুষের পাশাপাশি প্রাণী কল্যাণ নিশ্চিত করা।
জুনোটিক রোগ: যেসকল রোগ পশু-পাখি থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে পশু-পাখিতে ছড়ায় সেগুলোকে জুনোটিক রোগ বলা হয়, যেমন- তড়কা (Anthrax), জলাতঙ্ক (Rabies), যক্ষ্মা (Tuberculosis), ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি। এই রকম আরও অনেক জুনোটিক রোগ আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ চারটি জুনোটিক রোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
যক্ষ্মা (Tuberculosis)
যক্ষ্মা: মাইকোব্যাক্টিরিয়াম এর বিভিন্ন প্রকারের স্পেসিস যেমন Mycobacterium tuberculosis, Mycobacterium bovis দ্বারা সৃষ্ট জুনোটিক রোগ যা মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং তার মধ্যে ৫ লাখ মানুষ এই প্র্রাণঘাতি রোগে মৃত্যুবরণ করে। এই রোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুস আক্রান্ত হলেও দেহের অন্যান্য প্রায় সকল অঙ্গে যক্ষ্মা সংক্রমিত হতে পারে। মাইকোব্যাক্টিরিয়াম বোবিস ছাড়াও মাইকোব্যাক্টিরিয়াম টিউবারকুলোসিস এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
লক্ষণ (গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণী):
লক্ষণ (মানুষ) :
১. একটানা ৩ সপ্তাহের বেশি কাশি থাকা এবং কাশির সাথে রক্ত আসা (ফুসফুস সংক্রমনের ক্ষেত্রে)।
২. সবসময় ক্লান্তিভাব ।
৩. জ্বর এবং রাতে ঘেমে যাওয়া।
৪. ক্ষুধামন্দা এবং ওজন কমে যাওয়া।
রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া:
প্রতিরোধের উপায়:
ব্রুসেলোসিস (Brucellosis)
ব্রুসেলোসিস: ব্রুসেলা ব্যাক্টেরিয়ার বিভিন্ন প্রকারের স্পেসিস যেমন Brucella abortus, Brucella melitensis দ্বারা m„ó জুনোটিক রোগ যা গাবদিপশুর গর্ভপাত, বন্ধাত্ব, জরায়ু প্রদাহ তৈরির মাধ্যমে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ব্রুসেলোসিস মানব স্বাস্থ্যের জন্য h‡_ó ঝুকিপূর্ণ, এতে মানুষের জ্বর ও অন্ডকোষের প্রদাহ সহ স্থায়ী বন্ধাত্ব রোগ হতে পারে।
লক্ষণ (গবাদিপশু):
লক্ষণ (মানুষ):
১. জ্বর (Undulant Fever), মাথাব্যাথা।
২. অন্ডকোষের প্রদাহ (Orchitis), গ্রন্থি ফোলা।
৩. প্রচুর ঘেমে যাওয়া, দূর্বলতা এবং ওজন কমে যাওয়া।
রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া:
প্রতিরোধের উপায়:
১.সংক্রমিত ব্যক্তি বা প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিৎ করে চিকিৎসা করা।
২.আক্রান্ত গবাদিপশুর দুধ, মাংস পরিহার করা।
৩.গবাদিপশু, পোষা প্রাণী ও চিড়িয়াখানার প্রাণীকে প্রতিবছর আর বি টি (Rose Bengle Test ) করে ঐ সকল গবাদিপশু ও প্রাণিতে ব্রুসেলা জীবানু নাই তা নিশ্চিত করা।
৪.আক্রান্ত গবাদিপশু, পোষা প্রাণী ও চিড়িয়াখানার প্রাণীকে ব্যাথাবিহীন প্রক্রিয়ায় মৃত্যু নিশ্চিৎ করে মাটিতে পুতে ফেলা বা পুড়িয়ে দেয়া।
৫.সুস্থ্য গাবদিপশু, পোষা প্রাণী ও চিড়িয়াখানার প্রাণীকে নিয়মিত প্রতিষেধক টিকা প্রদনা করা।
৬.এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
তড়কা (Anthrax)
তড়কা: ব্যাসিলাস এন্থ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা m„ó মেরুদন্ডী প্রাণী বিশেষত গরু, ছাগল, ভেড়ার একটি মারাত্মক সংক্রমক রোগ যা সহজেই প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। আক্রান্ত এলাকার মাটি, ঘাঁস, লতাপাতা এবং আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শের মাধ্যমে সুস্থ প্রাণীতে ছড়ায়। এই ব্যাক্টেরিয়া স্পোর তৈরি করার মাধ্যমে আক্রান্ত এলাকায় শতশত বছর বেঁচে থাকতে পারে। রোগটি প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হলেও মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বন্যপ্রাণী এই রোগের প্রতি সংবেদনশীল এবং রোগ বিস্তারের উৎস হিসেবে কাজ করে।
লক্ষণ (গবাদিপশু):
আক্রান্ত প্রাণীর উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর (১০৬-১০৭০ ফা.) হয় এবং হঠাৎ মারা যায় পায়খানার রাস্তা দিয়ে আলকাতরা রং এর রক্তপাত হয় এবং রক্ত জমাট বাঁধে না।
লক্ষণ (মানুষ):
সংক্রমণের স্থান অনুসারে মানুষে তিন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়-
১। ত্বকে সংক্রমণ।
২। শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ।
৩। পাচনতন্ত্রে সংক্রমণ।
রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া:
প্রতিরোধের উপায়:
১. আক্রান্ত গবাদিপশুকে কোন অবস্থাতেই জবাই করা যাবে না বা মৃত পশুর চামড়া ছড়ানো বা হাড় সংগ্রহ করা যাবে না এবং রোগের লক্ষণ দেখা দিলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসে খবর দিতে হবে।
২. এই রোগে মৃত গবাদি পশুকে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে, কোন অবস্থাতেই খোলা জায়গায় ফেলে রাখা যাবে না বা নদী বা খালে ভাসিয়ে দেয়া যাবে না।
৩. আক্রান্ত এলাকার গবাদিপশুকে বছরে অন্তত একবার তড়কা টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
৪. সংক্রমিত মাঠে গবাদিপশুকে চারণ করানো যাবে না এমনকি ঐ মাঠের ঘাস কেটে এনেও গাবদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না।
৫. সংক্রমণ দেখা দিলে সংক্রমিত এলাকায় গবাদিপশুর চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
৬. এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
জলাতঙ্ক (Rabies)
জলাতঙ্ক: মানুষসহ সকল উষ্ণ রক্ত wewkó স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রের একটি মারাত্মক জুনোটিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা প্রাণীর গলবিলের পেশী অবশতার কারণে জল গ্রহণে অসুবিধা জনিত ভীতির সৃষ্টি হয় বলে রোগটিকে জলাতঙ্ক বলা হয়। Rabies Virus এর সংক্রমণে কারণে এই রোগ হয়। কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বাদুর, বানর, মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া প্রায় সকল প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী এই রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রকারভেদ: লক্ষণ প্রকাশের ধরণ অনুযায়ী এই রোগ সাধারণত দুই প্রকার, যথা- ফিউরিয়স ফরম বা উন্মততা:
এই প্রকারের রোগের ক্ষেত্রে নিম্নাক্ত লক্ষণ সমূহ দেখা যায়:
১. আলো ও পানি দেখে ভয় পাওয়া।
২. মুখ দিয়ে অনবরত ফ্যানাযুক্ত লালা ঝরা।
৩. উন্মততা ও আক্রমণাত্মকভাব।
৪. অনিদ্রা, উদ্বেগ ও ক্ষুধামন্ধা, পরিণতিতে মৃত্যু।
ডাম্প ফরম বা পক্ষাঘাত: এই প্রকারের রোগের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত লক্ষণ সমূহ দেখা যায়-
১. আলো ও পানি দেখে ভয় পাওয়া।
২. খাদ্য ও পানি গিলতে না পারা।
৩. দেহের পিছনের অংশ অবশ হয়ে যাওয়া।
৪. অনিদ্রা, উদ্বেগ ও ক্ষুধামন্ধা, পরিণতিতে মৃত্যু।
রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া:
* আক্রান্ত প্রাণীর আঁচড় বা কামড়ে এই রোগ আক্রান্ত প্রাণী থেকে সুস্থ প্রাণীতে ছড়ায়।
প্রতিরোধের উপায়:
১. সুস্থ মানুষ, পোষা প্রাণী ও গবাদিপশু নিয়মিত প্রতিষোধক টিকা (Pre-exposer Vaccine) প্রদান করা।
২. কোন কারণে আক্রান্ত প্রাণী সুস্থ মানুষ, পোষা প্রাণী ও গবাদিপশুকে আঁচড় বা কামড় দিলে আক্রান্ত স্থান কাপড় কাঁচা সাবান বা সোডা দিয়ে যতদ্রুত সম্ভব ধুয়ে ফেলা এবং মানুষের সিভিল সার্জন এর কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিষেধক টিকা (Post-exposer Vaccine) গ্রহণ করা। মানুষ ব্যতিত অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে নিকটস্থ ভেটেরিনারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা।
৩. বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
৪. এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।