মাছ চাষ

গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

Md Alamin Sarker | ১৬ মে ২০২৪

গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে গুলশা মাছ আবহমান কাল থেকে বাঙ্গালীদের খুব প্রিয় মাছ হিসেবে সমাদৃত। মাছটি খেতে খুব সুস্বাদু এবং বাজার মূল্যও অনেক বেশী। এক সময় এদেশের নদ-নদী, ধান-ক্ষেতে, হাওড়, বাওড় ও খাল-বিলে এ মাছ প্রচুর পাওয়া যেত কিন্তু নদ-নদীর উজানে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ধান ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার, বিল সেচে শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে প্রজনন ক্ষেত্রে ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাপ্যতা দারুণভাবে হ্রাস পায়। পরবর্তীতে মাছটির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘ গবেষণায় এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবনে সফলকাম হয়।

গুলশা মাছের বৈশিষ্ট্য

  • এ মাছে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও অণুপুষ্টি বিদ্যামান থাকে।
  • গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
  • ছোট কিংবা বড় জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
  • কার্পজাতীয় মাছের সাথেও একত্রে চাষ করা যায়।
  • খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় মাছের তুলনায় এ মাছগুলো বেশী পছন্দ করে।
  • বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী।

গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন

ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা

কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রাকৃতিক জলাশয় (নদী. হাওড়, বিল) হতে গুলশা মাছ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ মাছের প্রজনন কাল মে হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বে গুলশা মাছ সংগ্রহ করে পরিচর্যার মাধ্যমে ব্রুড মাছ তৈরী করা হয়।

নিম্নে ব্রুড সংগ্রহ ও পরিচর্যা বিষয়ে বর্ণনা করা হলোঃ

  • প্রজনন পুকুরের আয়তন ২৫-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৪-৫ ফুট হতে হবে।
  • চুন ও সার প্রয়োগে পুকুর প্রস্তুতির পর গুলশা মাছ এককভাবে মজুদ করতে হবে।
  • প্রজনন মৌসুমের ৩-৪ মাস পূর্বে অর্থাৎ  জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের গুলশা মাছ সংগ্রহ করে শতাংশে ৬০-৭০ টি পুকুরে মজুদ করতে হবে।
  • সম্পূরক খাবার হিসেবে সুষম খাদ্য তৈরীর লক্ষ্যে চালের কুঁড়া (৪০%), সরিষার খৈল (২০%), ফিশমিল (২৫%), মিট ও বোন মিল (১০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবণ (১%) এর মিশ্রণ প্রতিদিন মাছের দেহ ওজনের ৭-৮% ব্যবহারে ভাল ব্রুড তৈরী হয়।
  • প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য শতাংশে ৪ কেজি গোবর এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পুকুরে ব্যবহার করতে হবে।

কৃত্রিম প্রজনন

গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকেঃ

  • কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘন্টা পূর্বে ব্রুড পুকুর থেকে প্রজননক্ষম গুলশা মাছ ধরে হ্যাচারীতে রাখতে হবে
  • স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে একটি করে পিটুইটারী দ্রবণের ইনজেকশন পৃষ্ঠ পাখনার নীচে দেয়া হয়।
  • পিটুইটারী দ্রবণের মাত্রাঃ পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ৪-৫ ও ৮-১২ মিলিগ্রাম পিজি/ কেজি শারিরীক ওজনে প্রয়োগ করা হয়।
  • ইনজেকশন দেয়ার পর ১:১ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • হাপায় পুরুষ ও স্ত্রী মাছ ছাড়ার ৭-৮ ঘন্ট পরেই মাছ প্রাকৃতিকভাবে ডিম দিয়ে থাকে। এই নিষিক্ত ডিম থেকে ২০-২২ ঘন্টা পর রেণূ পোনা ফূটে বের হবে।
  • অতপর রেণু পোনা হাপাতেই ২-৩ দিন রাখতে হয়। ডিম্বথলি নিঃশোষিতক হওয়ার পর ১.০ লক্ষ রেণু পোনার জন্য প্রতিবার ১ টি সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক খাবার হিসাবে প্রতিদিন ৪ বার সরবরাহ করতে হবে।

গুলশা পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা

নার্সারী পুকুরে পোনা পালন

  • নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হলে ভাল হয়।
  • পুকুর প্রস্তুতির সময়ে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য শতাংশে ২০ কেজি হারে গোবর সার দিতে হবে।
  • নার্সারী পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণূ পোনা শতাংশে ৮,০০০-১০,০০০ টি  মজুদ করা যায়।
  • এ সময় নার্সারী পুকুরকে ১.০ মিটার উচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। ফলে ক্ষতিকর রাক্ষুসে ব্যাঙ বা সাপ পুকুরে প্রবেশ করে  পোনার ক্ষতিসাধন করতে পারে না।
  • প্রতি শতাংশে প্রথম ৩ দিন ২ টি করে ডিমের কুসুম পানিতে মিশ্রণ করে সকাল, দুপুর ও বিকেলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • ৮-১৫ দিন: সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
  • রেণু পোনা ছাড়ার ৩০ দিন পর চারা পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী।

গুলশা মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

গুলশা মাছ একক বা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যায়। নিম্নে এই মাছের চাষ পদ্ধতির বর্ণনা করা হলোঃ

গুলশা মাছের একক চাষ

পুকুর প্রস্তুতি-

  • সাধারণত: ১৫-২৫ শতাংশের যে কোন পুকুরে যেখানে পানির গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার এমন পুকুরে এই মাছের একক চাষের জন্য উপযোগী।
  • পুকুরের পাড়ে মেরামত ও জলজ আগাছা পরিস্কার করে নিতে হবে এবং শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক।
  • চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশে ৬ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • গোবর সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।

পোনা মজুদ

  • সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর ৩-৪ গ্রাম ওজনের পোনা শতাংশে ২৫০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
  • পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুনাবলী যাতে সহনশীল হয় সে জন্য পোনাকে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।

খাদ্য ও সার প্রয়োগ

  • পোনা মজুদ করার পর দিন থেকে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ২০-৬ ভাগ হারে সম্পূরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া (২০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবণ (১%) এর মিশ্রণ সরবরাহ করতে হবে।
  • প্রতি ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ  করে  খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
  • রৌদ্রজ্জল দিনে জৈব সার গোবর (প্রক্রিয়াজাত) সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • সপ্তাহে একবার পুকুরে হররা টানতে হবে।
  • পুকুরে পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • পানির স্বচ্ছতা ২০ সেঃমিঃ এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

এই চাষ পদ্ধতিতে ৬ মাসে গুলশা মাছ ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। মাছ আহরণকালে পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষ করে ৬-৭ মাসে হেক্টরে ২,২০০ থেকে ২,৫০০ কেজি মাছ ‍উৎপাদন করা যায়।

আয়-ব্যয়

একক চাষ পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষে ৬ মাসে হেক্টরে ২.২০ লক্ষ টাকা ব্যায় করে প্রায় ১.৫০-১.৮০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।

রুই জাতীয় মাছের সাথে গুলশা মাছের মিশ্র চাষ

অর্থনৈতিক বিবেচনায় রুই জাতীয় মাছের সাথে গুলশা মাছের মিশ্র চাষ করা লাভজনক। ফলে সহঅবস্থানের মাধ্যমে একই পুকুর থেকে গুলশাসহ রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। নিম্নে চাষ পদ্ধতির ধাপসমূহ বিধৃত করা হলোঃ

পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি-

  • মিশ্র চাষের জন্য ৪০-৬০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করতে হবে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৮-৯ মাস ৪-৬ ফুট পানি থাকে।
  • পুকুর থেকে রাক্ষুসে  অবাঞ্চিত মাছ দূর করার জন্য মিহি ফাঁসের জাল বার বার টেনে এদের সরাতে হবে।
  • রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দুর করার পর শাতংশে ১ কেজি চুন, ৩-৪ দিন পর ৬-৮ কেজি পঁচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।
  • সার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর পুকুরের পানি সবুজাভ হলে পোনা মজুদ করতে হবে।

পোনা মজুদ

প্রতি শতাংশে ৫-৭সে.মি. আকারের ৮০ টি গুলশা এবং ১০-১২ সে.মি. আকারের ৮টি কাতলা, ১২ টি রুই, ১০ টি মৃগেল ও ২ টি গ্রাস কার্প এর সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।

খাদ্য ও সার প্রয়োগ

  • পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে চালের কুঁড়া (৪০%), গমের ভুষি(২৫%) সরিষার খৈল(২০%) ও ফিশমিল (১৫%) মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৮-৩ ভাগ হারে দেয়া যেতে পারে।
  • পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ৪ কেজি গোবর (প্রক্রিয়াজাত) প্রয়োগ করতে হবে।

চাষ ব্যবস্থাপনা

অপেক্ষাকৃত ভাল উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত বিষয় সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবেঃ

  • নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
  • প্রতি সপ্তাহে একবার হররা টানতে হবে।
  • পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • পানির স্বচ্ছতা ২০ সে.মি. এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

আহরণ ও উৎপাদন

  • গুলশা মাছ ৬০-৮০ গ্রাম ওজনের হলে বিক্রয়ের জন্য আহরণ করা যেতে পারে।
  • পোনা মজুদের ৮-৯ মাস পর সমস্ত মাছ আহরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • গুলশা মাছ ধরার জন্য প্রথমে ঝাঁকি জাল এবং পরে পুকুর শুকিয়ে ধরা যেতে পারে।
  • উল্লেখিত চাষ পদ্ধতিতে হেক্টরে গুলশা ৮০০-৯০০ কেজি এবং রুই জাতীয় মাছ ৪,৫০০-৫,০০০ কেজি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।

আয়-ব্যয়

গুলশা মাছের সাথে রুই জাতীয় মাছ চাষে হেক্টরে প্রায় ২.০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ২.৫০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা যায়।

পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা

পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় নিম্নবর্ণিত সমস্যা সমূহ পরিলক্ষিত হয়ঃ

  • উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা না করলে ব্রুড মাছের প্রজনন পরিপক্কতা সঠিকভাবে হয় না।
  • হ্যাচারীতে রেণু পোনা যথাপোযুক্ত পরিচর্যা না করলে পোনার মৃত্যুর হার বেশী হয়ে থাকে।
  • হ্যাচারিতে রেণু পোনা বা পুকুরে মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে।
  • পানির ভৌত রাসায়নিক গুনাগুণ মাছ চাষের উপযোগী না থাকলে মাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় না।

পরামর্শ

  • প্রজনন মৌসুমে ব্রুড গুলশা মাছের নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে।
  • ব্রুড গুলশা মাছকে আমিষ সমৃদ্ধ (৩৫-৪০%) সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
  • নিয়মিত পানির গুনাগুণ পর্যবেক্ষণ  করতে হবে।
  • ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য ও প্রজনন পরিপক্কতা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
  • পোনা উৎপাদনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।