মৎস্য খাতের প্রযুক্তি

একোয়াপনিক গার্ডেনিং ও ভাসমান খাঁচায় গুলশা চাষ

Jakia sultana | ১৪ মে ২০২৪

একোয়াপনিক গার্ডেনিং এর মাধ্যমে নিরাপদ মাছ ও সবজি উৎপাদন

 

একোয়াপনিক পদ্ধতি হলো সমন্বিত মাছ ও সবজি চাষ যেখানে মাছ চাষে ব্যবহৃত পানি গাছের পুষ্টির যোগান দেয় এবং রি-সারকুলেটরি পদ্ধতিতে সেই পানি পরিষ্কার হয়ে মাছ চাষে ব্যবহৃত হয়। মাছ, ব্যাকটেরিয়া এবং গাছ এই তিনটি রি-সারকুলেটরী পদ্ধতির উপাদান যেখানে মাটি ছাড়া গাছ/সবজি উৎপাদিত হয়। এই পদ্ধতিতে ড্রাম বা ট্যাংকে মাছ চাষ করা হয় এবং মাছের মর-মূত্র ও মাছে সরবরাহকৃত খাদ্য ব্যাক্টেরিয়াল পঁচন ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের জন্য পুষ্টি তৈরি হয়। একোয়াপনিক পদ্ধতি দেশের শহরাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

একোপনিক পদ্ধতির কাযর্প্রণালী

একোয়াপনিক পদ্ধতিতে দুইটি প্রধান অংশ বিদ্যমান যেমন-একোয়াকালচার অর্থাৎ মাছের চাষ এবং হাইড্রোপনিক অর্থাৎ গাছের (সবজি) চাষ। মাচ চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত খাদ্য ও মাছের দেহ হতে উৎপাদিত বর্জ্য (যেমন NH3) মাছের স্বাস্ত্যের জন্য হানিকর। আবার এই বর্জ্য পদার্থ ব্যাক্টেরিয়াল পঁচন ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের জন্য পুষ্টি (NH3 ভেঙ্গে N2) তৈরী করতে সক্ষম।

একোয়াপনিক পদ্ধতির উপাদানসমূহ

১. একোয়াকালচার সিষ্টেম/মাছ চাষের ট্যাংক : মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন আকারের ট্যাংক ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন গোলাকার বা আয়তাকার অথবা বর্গাকৃতি। এই ট্যাংকের ভিতর পানি দিয়ে মাছ চাষ করা যায় এবং চাষের জন্য এক ঘনমিটার থেকে বেশি আয়তনের ট্যাংক উপযোগী।

২.বায়োফিল্টার : এটা এমন একটি সিস্টেম যেখানে নাইট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া মাছের ট্যাংকে উৎপাদিত বর্জ্য হতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান তৈরি করে। নুড়ি পাথর, মোটা বালি ও ঝিনুকের খোলস দিয়ে বায়োফিল্টার তৈরি করা হয়।

৩. হাইড্রোপনিক সিস্টেম/সবজি চাষের ট্রে : হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেমে মাটির পরিবর্তে পানিতে সবজি চাস করা হয়। এমএস সীটের ট্রে, ফাইবার গ্লাস ট্রে অথবা কংক্রিটের ট্রে সবজি চাষের জন্য উপযোগী। এখানে সবজি তার শিকড়ের মাধ্যমে বায়োফিল্টার হতে আগত পানি থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহন করে বৃদ্দি প্রাপ্ত হয় এবং পানিকে পরিশোধনের মাধ্যমে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলে।

৪. সাম্প ট্যাংক : এটি একটি ট্যাংক যেখানে হাইড্রোপনিক সিস্টেম বা সবজির ট্রের পানি অভিকর্ষজ শক্তির মাধ্যমে জমা হয় এবং এই পানি পাম্পের সাহায্যে মাছের ট্রেতে পুনরায় ফিরে আসে।

৫. পাম্প ও অক্সিজেন সরবরাহকারী সরজ্ঞাম : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে ০.৫ হর্স পাওয়ারের পাম্প ব্যবহার করা হয় যা পানি উত্তোলনের কাজে সহায়তা করে। মাছের ট্যাংকে এবং সবজির ট্রেতে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য ছোট এরেটর বা এয়ার ব্লোয়ার বা এয়ার কমপ্রেসার ব্যবহার করা যেতে পারে।

নাইট্রিফিকেশন ও পুষ্টি উপাদান : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে এ্যারোবিক কনভারশনের মাধ্যমে অ্যামোনিয়া নাইট্রেটে পরিবর্তিত হয় যা এই পদ্ধতির অন্যতম প্রধান কাযর্ক্রম। মাছে ব্যবহৃত অতিরিক্ত খাদ্য, মাছের মল-মূত্র হতে অ্যামোনিয়া উৎপাদিত হয় যা আবশ্যিকভাবে ফিল্টার করা দরকার। Nitrosomas ব্যাকটেরিয়া অ্যামোনিয়া ভেঙ্গে নাইট্রাইট এ পরিণত করে যা পরবর্তিতে Nitrobacter ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে নাইট্রেটে পরিণত হয়। নাইট্রেট গাছের পুষ্টি সরবরাহে কাযর্করী ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে ক্যালসিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড ব্যবহার করা হয় যা পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে।

সবজি ও মাছ উৎপাদন : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। গিফট তেলাপিয়া, থাই কৈ, ভিয়েতনামী কৈ, সরপুঁটি এবং যে সকল মাছ ট্যাংকে চাষ করার উপযুক্ত সে সব মাছ চাষ করা যায়। ঢেড়স, পুঁইশাক, কলমি, পুদিনা, টমেটো, লেটুস, স্ট্রবেরী ইত্যাদি জাতের সবজি ও ফল চাষ করা যায়। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পযর্ন্ত সময়ে শীতকালীন সবজি ও মাছ উৎপাদন করা যায়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পযর্ন্ত সময়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও মাছ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।

গাছের চারা রোপন  : হাইড্রোপনিক ট্রেতে ককসিট স্থাপন করা হয় এবং ককসিটে সবজির জাত অনুযায়ী ছিদ্র করে স্পঞ্জ দিয়ে চারা রোপন করা হয়। জাত ভেদে প্রতি বর্গমিটারে ৯-২৭ টি চারাগাছ রোপন করা হয়।

মাচের পোনা মজুদ ও খাদ্য প্রয়োগ : একোয়াকালচার সিস্টেমে ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া মাছ প্রতিঘন মিটারে ৬০ টি ও প্রতিঘন মিটারে ৮-১০ গ্রাম ওজনের ১০০-১২০ টি থাই কৈ মাছ মজুদ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার হাইড্রোপনিক ট্রের জন্য প্রতিদিন ৮০-১০০ গ্রাম খাবার প্রয়োগ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে ১২০ দিনে প্রতি ঘন মিটারে ৭-৮ কোজ তেলাপিয়া উৎপাদিত হয়ে থাকে।

ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছের চাষ

বিগত কয়েক বছর হতে আমাদের দেশে বিভিন্ন নদ-নদীতে খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ হচ্ছে। মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট এর স্বাদুপানি কেন্দ্র হতে গুলশা মাছ খাঁচায় চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। সহনশীর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাসমান খাঁচায় উচ্চমূল্যের গুলশা মাছ চাষ করে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টির অভাব পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।

  • ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষের জন্য কমস্রোতের ছোট বা বড় নদীর অংশবিশেষকে নির্বাচন করা যেতে পারে।
  • সারা বছর যাতে ৩-৪ মিটার পানির গভীরতা, দূষণমুক্ত পরিবেশে স্বচ্ছ পানি, মাছ বাজারজাত করার সুবিধা এবং চুরি ডাকাতির প্রবণতা নেই বললেই চলে এমন স্থানে খাঁচা স্থাপন করতে হবে।
  • খাঁচা তৈরির জন্য ১.০ সেমি. ফাঁসের নটলেস পলিথিলিন জাল ও খাঁচার উপরিভাগ ঢাকার জন্য ৭.০-৭.৫ সেমি. ফাঁসের কডের জাল ব্যবহার করা উত্তম।
  • সাধারণত ১৮ (৩*৩*২) ঘনমিটার আকারের জালের খাঁচা গুলশা মাছ চাষের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে।
  • খাঁচার তলদেশ এবং চারপাশে খাঁচা তৈরীর জাল দিয়ে সেলাই করে আটকে দিতে হবে। অতঃপর উপরিতলে ঢাকনার জাল সেলাই করে দিতে হবে।
  • নদীতে খাঁচা স্থাপনের জন্য প্রথমে খাঁচার মাপের বাঁশের তৈরী ফ্রেম প্লাস্টিকের ড্রামের সাথে বেঁধে পানিতে স্থাপন করতে হবে।
  • খাঁচার চার কোণায় প্লাস্টিক রশির লুপ বেঁধে ফ্রেমের সাথে জাল পানিতে ঝুলিয়ে স্থাপন করতে হবে।
  • নদীর নির্দিষ্ট স্থানে খাঁচা সারিবদ্ধভাবে বিন্যাস করার পর চতুর্দিকে বাঁশের বেষ্টনী তৈরী করতে হবে।
  • খাঁচাগুলিকে দুইপাশে মোটা প্লাস্টিক রশি দ্বারা বেঁধে জলাশয়ের পাড় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে নোঙ্গরের সাহায্যে স্থাপন করতে হবে।

খাঁচায় পোনা মজুদকরণ

  • পোনা মজুদের ক্ষেত্রে পোনার ওজন গড়ে ২.৫-৩.০ গ্রাম হলে ভাল হয়।
  • খাঁচায় প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ৫০০ টি গুলশা মাছের সুস্থ সবল পোনা ৫-৬ মাস চাষ করে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
  • খাঁচায় পোনা ছাড়ার পূর্বে ফিল্টার নেটের নার্সারি হাপায় পোনাগুলোকে অন্তত ১-১.৫ মাস লালন করে নিলে খাঁচায় পোনা মজুদের পর মৃত্যু কম হয়।
  • খাঁচায় পোনা মজুদের আগের দিন সার্মারি হাপায় পোনাকে খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে হবে এবং মজুদ করণের ৬-৭ ঘন্টা পর অল্প অল্প করে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা

  • ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সম্পূরক খাদ্যে কমপক্ষে ৩০% আমিষ থাকা আবশ্যক।
  • নার্সারি অবস্থায় গুলশা মাছের দেহ ওজনের ১৫% হিসেবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
  • চাষকালীন সময়ে ১ম দুই মাস ৮-১০%, পরবর্তী ২ মাস ৭-৮% এবং শেষ দুই মাস ৫% হিসেবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
  • ফিডিং ট্রে ব্যবহার করার পরও সরবরাহকৃত খাদ্যের প্রায় শতকরা ৩০-৪০ ভাগ অপচয় হয় যা পানিতে পঁচে পানি দূষণ ও মাচের মড়কসহ আর্তিক ক্ষকি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খাঁচায় ভাসমান পিলেট জাতীয় খাদ্য দৈনিক ২/৩ বার যতক্ষণ খাঁচার মাচ খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় ততক্ষণ পযর্ন্ত প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
  • স্রোতে ভেসে আসা জলজ উদ্ভিদ/আগাছা যেন খাঁচার বাহিরে জমা হয়ে পানি প্রবাহ কমিয়ে না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নদীতে খাঁচা স্থাপন করে বিলুপ্ত প্রায় গুলশা মাছ সহজে চাষ করা যায়। ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষ করে প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৯-১০ কেজি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মাছ একত্রে আহরণ অপেক্ষা ৪-৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ৬ মাস পযর্ন্ত বেছে বেছে বড় মাছ আহরণ করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়।