ভূমিকা
ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ জলসম্পদ পরিপূর্ণ একটি দেশ । এদেশে প্রজাতির মৎস্যবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অসংখ্যা মুক্ত জলাশয় । কিন্তু প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণে এ সকল জলাশয়ে মৎস্যবৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক রু্ই জাতীয় মাছের উৎপাদন আজ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে । অথচ দেশের মৎস্য খাত ও বিশাল জনগোষ্ঠী দৈনদিন পুষ্টি উপাদান চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা । তাই মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহ দূরীকরণ এবং প্রাকৃতিক ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ সীমিতকরণের পাশাপাশি জলাশয় জৈবিক ব্যবস্থাপনা । জৈবিক ব্যবস্থাপনার যার মাধ্যমে বিলের বা বিল তীরবর্তী কোন জলাধারে হ্যাচারিতে উৎপাদিত দেশীয় জাতীয় মাছের রেণু মজুদ করে কম খরচ অঙ্গুলি পোনা উৎপাদন মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করে প্রাকৃতিক মাছের পাশাপাশি বড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা ।
*বিল নার্সারী স্থাপনের মাধ্যমে মুক্ত জলাশয় রুই জাতীয় মাছের মজুদ বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
*সরাসরি পেনা ক্রয় না করে বিল নার্সারী মাধ্যমে বিলে পোনা মজুত করলে খরচ কম ও টেকসই হয় ।
*সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অঙ্গুলি পোনা উৎপাদন করে বিলে অবমুক্ত করায় পোনার বাঁচার হার বৃদ্ধি করে । এর মাধ্যমে অবলুপ্তির হাতে হতে রক্ষা করা যায় ।
*বিল নার্সারী উৎপাদিত পোনা বিলে অবমুক্ত করে মৎস্য আইনের আওতায় সংরক্ষণ কায্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয় বলে একই সাথে অন্যান্যা দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ।
*বিল নার্সারী স্থাপন কার্যক্রম বিল তীরবর্তী জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের বাস্তবায়ন করা হয় বিধায় এ ক্ষেত্রে সফলতা অনেক বেশি ।
*বিলনার্সারী কায্যক্রমের সুফল বিল পাড়ের সকল জনগণই সমভাবে পায় বলে এ কার্যক্রম তাঁদের অংশগহণ থাকে স্বতস্ফুর্ত ।
*সুফলভোগীদের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়ায় তাঁরা সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ।
বিল নার্সারী স্থাপনের উপযোগী জলাশয়
*প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য বিস্তার ও জীববৈচিত্রসংরক্ষন উপযোগী বা কোন উন্নুক্ত জলাশয়ের সাথে সংযুক্ত কোন জলাধার। নিদ্দিষ্ট পালনকালো অতিক্রম হওয়ার পর বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয় অথাবা কেটে উৎপাদিত পোনা উন্মক্ত জলাশয় অবমুক্ত করা যায় এমন জলাধার ।
* সরকার খাস/ আধা- সরকারি / বে- সরকারি বা ব্যক্তি মালিকাধীন কোন জলাধার ।
*রেণু ও অন্যান্য উপকরণ পরিবহনে সহজে যাতায়াত করা যায় এমন জলাধার।
বিল নার্সারী প্রস্তুতকরণ
বিল নার্সারী স্থাপনের শুরুতে নির্ধারিতদ জলাধারকে রেণু চাষের উপযোগী করতে ও রেণু – পোনার প্রাকৃতিক খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করা জরুরি । নিম্নে সংস্কার ও প্রস্তুতিমূলক কাজসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচতনা করা হলো:
ক)আগাছাও ঝোপ-ঝড় পরিস্কার :
জলাধারে আগাছাও ঝোপ-ঝড় থাকলে সূর্যের আলো পানিতে পড়তে বাধা দেয়, মাটি পানির পুষ্টি উপাদন ব্যবহার করে এবং রোগ –জীবাণু উপস্থিতি বৃদ্ধি করে । তাই আগাছা, ঝেপ –ঝড় ওগাছের ডাল পালা পরিষ্কার সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশে করতে দিতে হবে ।
খ)পাড় ও তলা মেরামতঃনার্সারী পুকুরের পাড়ে এমন উঁচু করতে হবেত যেন আকস্মিক বর্ষার পানি ডুবে না যায় । পাড় ভাঙ্গা বা পাড়ের গায়ে গর্ত থাকলে তা মাটি দিয়ে ভরাট করত দিতে হব । পুকুর পাড়ের ঢাল ২:১অনুপাত রাখলে সূর্যের আলো কার্যকরভাবে পুকুরের পানিতে পড়বে এবং প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের সহায়ক হবে । পুকুতর তলারি অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হতে যাতে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি না হয় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা না দেয় ।
গ)রাক্ষুসে মাছ দূরীকরণ
নার্সারী জলাধারের রাক্ষুসে মাছ দূর করতে হবে কেননা রাক্ষুসে মাছ উৎপাদিত পোনা মাছকে খেয়ে ফেলে । জলাশয় শুকিয়ে বা বিষ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে মাছ দূর করা যায় । জলাশয় শুকিয়ে দূর করাই উত্তম । অন্যদিকে, বাজারে প্রচলিত বিষের মধ্যে রোটেনন ব্যবহারের মাধ্যমে রাক্ষুসে মছ দূর করাই ভাল । এতে পুকুরের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর কোন বিরুপ প্রভাব পড়ে না । ৯.১%শক্তিমাত্রার রোটেনন ১৮-২০ গ্রাম /ফুট পানির গভীরতা শতাংশ বা ৭% শক্তিমাত্রার প্রয়োগ করে রাক্ষুসে মাছ দূর করা যায় । এ বিষয়ে বিষাক্ততার মেয়াদ প্রায় ৭দিন ।
ঘ)চুন প্রয়োগ
জলাশয় চুন প্রয়ো করলে রোগ জীবাণু দূর হয়, তলার গ্যাস দূর হয় পানিতে প্রাকতিক খাদ্য তৈরিতে সহায়তা করা । বিষ প্রয়োগের ৭দিন পর নার্সারী পুকুরের প্রতি শতাংশে ১-২ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে । শুকনো পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে পরিমিত পরিমাণ চুন গুড়া করে ছিটিয়ে দিতে হবে । পানিযুক্ত পুকুরের ক্ষেত্রে চুন পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে ।
ঙ)সার প্রয়োগ
নার্সারী পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রার্চুতা বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন । চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর নার্সারী পুকুরে প্রয়োজনীয়তা প্রতি শতাংশ জলায়তনে ৮-১০কেজি কম্পোস্ট, ১৫০-২০০গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫-১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫-৩০ গ্রাম এমপিও পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে । রোদেলা দিনে দিনের প্রথম ভাগে সার প্রয়োগ করলে সারের কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যায় ।
চ)হাঁসপোকা দমন
প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে জলাশয় হাঁসপোকার উপস্থিতিও বৃদ্ধি পায় । এ হাঁপোকা পুকুরে মজুদকৃত রেণু খেয়ে ফেলে। তাই রেণু মজুদের ২৪ ঘন্টা পূর্বে বিষ প্রয়োগ করে হাঁসপোকা দমন করতে হব । বাজারে বিদ্যামন বিষের মধ্যে সুমিথিয়ন প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির গভীরতা জন্য ৩-৫মিলি পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে ।
বিল নার্সারীতে রেণু মজুদঃ
নির্বাচিত জলাধার বিল নার্সারিতে দেশীয় রুই জাতীয় মাছের রেণু হেক্টর প্রতি ২.৫কেজি হারে মজুদ করতে হবে । নির্বাচিত মাছের মধ্যে ২০%কাতলা,৫০%রুই এবং ৩০%মৃগেল / কালিবাউস /গনিয়া থাকা প্রয়োজন । হাঁসপোকা দমনের জন্য বিষ প্রয়োগের ২৪ঘন্টা পর পানির বিষাক্তা পরীক্ষা করে উপযোগী পেলে রেণু ছাড়তে হবে। রেণু ধারন করা হয় পলিথিন ব্যাগের পানিতে নার্সারীতে পানি মিশিয়ে উভয়
মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থপনা
ক) নিয়মিত সম্পূরক খাদ্য ও সার প্রয়োগ
রেণু মজুদর পর ১-৩ দিন রেণুর ওজনের সমপরিমাণ মিহি আটা পানিতে গুলে পাতলা করে (অর্ধেক সকালে ও অর্ধেক বিকালে ) নার্সারির চারিদিকে ছিটিয়ে দিতে হবে । ৪র্থ তেকে ১০ম দিনে রেণু ওজনের দ্বিগুন পরিমাণ মিহি কুড়া এবং সরিষার খৈল ১:১অনুপাতে মিশিয়ে পানিতে গুলে একইভাবে দ্বিগুন পরিমাণ মিহি কুড়া করতে হবে । তার পর ধানি পোনা নমুনায়ন করে দেহ ওজনে১০-২০%হারে উল্লেখিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে । সম্পূরক খাদ্য হিসেবে পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে প্রতি শতাংশে দৈনিক ২০০-২৫০গ্রাম গোবর ৫গ্রাম ইউরিয়া এবং প্রতি গ্রাম টিএসপি পানিতে গুল রোদেলা দিনের সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে ।
খ)রেণু বাঁচার হার ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাঃরেণু মজুদের পরদিন থেকে প্রতিদিন নার্সারির কিনারে গামছা টেনে রেণু ধরে রেণুর বাঁচার হার অনুমান ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে ।
*বিল নার্সারী উৎপাদিত পোনা অবমুক্তকরণ
সঠিক ব্যস্থাপনার মা্ধ্যমে রেণুর আকার ১০-১৫সে,মি, হলে উৎপাদিত পোনামাছের সংখ্যা বা পরিমাণ নিধারণের পর নার্সারী পুকুরের পাড় কেটে অথবা জাল টেনে ধরে বিলে অবমুক্ত করতে হবে । এ প্রদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি প্রায় ২.৫লক্ষ অঙ্গুলি পেনা উৎপাদন করা সম্ভব ।