সমুদ্র অর্থনীতি

সী উইড চাষ

Jakia sultana | ০৯ মে ২০২৪

সাগর উপকূলে সী-উইড চাষ

সী-উইড সাগরের এক প্রকার তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ। সী-উইড বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ, পুষ্টিগুণের বিচারে যা বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচ্যে বিশেষত জাপান, চীন ও কোরিয়ায় সনাতনভাবেই দৈনন্দিন খাদ্যে সী-উইড ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। মানব খদ্যে হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরী, ঔষুধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সী-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরীতে কাচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। সী-উইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য বিদ্যমান থাকায় খাদ্যে অনূপুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

বাংলাদেশের উপকূলে সী-উইড:

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফসহ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও বাঁকখালী মোহনার আশপাশের পাথুরে ও প্যারাবন এলাকায় জোয়ার-ভাটার অন্তবর্তী স্থানেই অধিকাংশ সী-উইড দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের উপকূলে প্রায় ১৪০ ধরণের সী-উইড দেখতে পাওয়া যায়।সী-উইড জন্মানোর জন্য কিছু ভিত্তির প্রয়োজন পড়ে। সাধারণতঃ বড় পাথর, প্যবাল, শামুক-ঝিনুক-পলিকিটের খোসা, প্যারাবনের গাপছ-শিকড়, শক্ত মাটি কিংবা অন্য যেকোন শক্ত বস্তুর উপর সী-উইড জন্মে। কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাকাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সালাদ ও চাটনী হিসেবে সী-উইড আহার করে থাকে।

ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২০১৩ সাল হতে সী-উইড নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইনস্টিটিউটের গবেষক দল কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় নুনিয়ারছড়া থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত সৈকত সংলগ্ন জোয়ার-ভাটা এলাকা ও ইনানী উপকূলে বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন সী- উইডের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্রে সনাক্ত করেছে। প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে মানানসই সী-উইড প্রজাতিগুলোর চাষ, পুষ্টিমান যাচাই এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের আলোকে খাদ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্তে গবেষণা চলমান রয়েছে। বিজ্ঞানীরা সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাকখালী মোহনা ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, শাপলাপুর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি সী-উইডের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্যে Enteromorpha (সাগর পাতা), Cau;arpa racemosa (সাগর আঙ্গুর) Hypnea spp. (সাগর সেমাই), Sargassum oligocystum (সাগর ঘাস), Padina tetrastromatica (সাগর ঝুমকা), Hydroclathrus clathratus (জিলাপী শেওলা), Catenella spp. (শৈবালমূল লতা) এবং Porphyra spp. (লাল পাতা) অন্যতম। সেই সাথে সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী ও বাকখালীতে ৩টি নির্বাচিত সী-উইড প্রজাতি-S. oligocystum, C. racemosa & H. musciformis পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হচ্ছে। উপকূলের লেগুন বা আশ্রয়যুক্ত স্থান যা সাগরের প্রবল ঢেউ ও স্রোতের প্র্রভাবমুক্ত, দূষণমুক্ত পানি এবং জনউপদ্রব কম এমন জায়গা সী-উইড চাষের জন্য উপযুক্ত। আমাদের জলবায়ুতে স্থানভেদে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস সী-উইড চাষ করা যেতে পারে। তবে সী-উইড চাষের সর্বোচ্চ অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকে জানুয়ারী থেকে মার্চ এই তিন মাস।

সী-উইড  চাষের কলাকৌশল:

সী-উইড (Hypnea sp.) চাষের জন্য নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি রশি দ্বারা ৪মি * ৪ মি. জাল (২০ সেমি. ফাঁস যুক্ত) আনুভুমিকভাবে স্থাপন করা হয়। নতুন জন্ম নেয়া অল্প বয়স্ক বাড়ন্ত গড়ে ৫ সেমি. দৈঘ্যের ৪+০.০৫ কেজি বীজ চাষের জন্য তৈরিকৃত জালের রশির গিটের ফাঁকে আটকিয়ে দেয়া হয়। জালটির চারপাম বাঁশের সাথে আলতো করে বেঁধে দেয়া হয় এবং ১০টি প্লাস্টিকের বয়া বা প্লাস্টিক ফ্লোটস আটকিয়ে দেয়া হয় যাতে জালটি সবসময় ০.৫-০১ মি. পানির গভীরতায় থাকে। সী-উইড ১৫ দিন পরে যখন ৩০=৫ সেমি. দৈর্ঘ্যে প্রাপ্ত হয় তখন সেগুলোর গোড়া বাদ দিযে আহরণ করা হয়্ এভাবে প্রতি ১৫ দিন পরপর আংশিক আহরণ ্ববেং ৯০ দিন পরে আহরিত সী-উইড মোট পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। প্রজাতি বেদে ৩-৪ মাসে প্রতি বর্গমিটার জালে কাঁচা শৈবালের উৎপাদন ৫০-৮০ কেজি।

সী-উইডের খাদ্য:

সী-উইডের প্রডাক্ট তৈরীর জন্য ৩টি প্রজাতি- Hypnea, C. racemosa ও S crassifolium ব্যবহার করা যায়। C. racemosa (সামুদ্রিক আঙ্গুর নামে পরিচিত) ভালভাবে পরিষ্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসাবে খাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সী-উইডসমৃদ্ধ খাদ্য আইটেমগুলো হলো- সালাদ, ‍সুপ, আচার, পিঠা, চানাচুর, জেলী, সস ইত্যাদি। সী-উইড কেবল খাদ্য বা শিল্পে কাপঁচামাল নয় ডেকরেশন আইটেম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ প্রযুক্তি আমাদের দেশে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্যোগ্ সী-উইড চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপকূলীয় জলাশয় চাসের আওতায় আনা সম্ভব। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে সী-উইড খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

 

                                                                       রচনায়: মোঃ মহিদুল ইসলাম ও ড. মোঃ ইনামুল হক

                                                                                          বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট