অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা

অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা

Jakia sultana | ১৬ মে ২০২৪

ভূমিকা

জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বর্তমানে জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশ নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন। এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সকল উন্মুক্ত জলাশয় জৈবিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনমুখী করা একান্ত অপরিহার্য। জৈবিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে অধিক কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা।

 

মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের লক্ষ্য

উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও মজুদ বৃদ্ধি এবং মা-বাবা মাছকে নির্বিঘ্নে বড় হওয়া ও প্রজননে সুযোগ সৃষ্টি করা।

 

মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্য

  • কোন জলাশয় বা জলাশয়ের নির্দিষ্ট অংশ মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল হিসেবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।
  • মাছের প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করার নিমিত্ত আকার ও প্রজাতি বিশেষে আহরণ নিয়ন্ত্রণ।
  • অনুকূল জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) পুনরূদ্ধার।
  • সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি করা।

 

মৎস্য অভয়াশ্রমের স্থান নির্বাচন

  • জলাশয়ের গভীরতম অংশ যা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে, যে স্থান রেণু বা চারা বা কিশোর মাছের নার্সারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • নদীর বিভিন্ন খন্ডিত অংশের প্রতিটিতে আলাদা আলাদা অভয়াশ্রম স্থাপন করা যেতে পারে।
  • প্রতিটি উন্মুক্ত জলাশয়ে/বিল/নদীতে কমপক্ষে ১টি অভাশ্রম স্থাপন করা প্রয়োজন।
  • মাছের আবাসস্থল, প্রজনন বৈচিত্রতা, অভিপ্রায়ন ও অভিগমন এবং তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার বিষয়াদি বিবেচনায় এনে প্রজাতিভিত্তিক বিভিন্ন জলাশয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের অভয়াশ্রম স্থাপন করা যেতে পারে।
  • মৎস্য অভয়াশ্রমটি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী বা লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়া বাঞ্চনীয় যাতে সহজে যাতায়াত ও তদারকি করা যায়।
  • ইজারাধীন ও ইজারামুক্ত উভয় প্রকার জলাশয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনার স্বার্থে স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদী অনাপত্তি পত্র (NOC) প্রদান করবেন।

 

মৎস্য অভয়াশ্রমের আয়তন নির্ধারণ

  • মৎস্য অভয়াশ্রমের আয়তন ও সীমানা সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। অভয়াশ্রম আয়তনে বড় এবং অভয়াশ্রমের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে ইতিবাচক প্রভাব দ্রুত ও বেশি হবে।
  • জলাশয়ের বিদ্যমান জলায়তনের শতকরা ৫-১০ ভাগ মৎস্য অভয়াশ্রম হতে পারে। মাছের প্রজাতির ভিন্নতা ও জীবন প্রক্রিয়া এবং জলাশয়ের বৈশিষ্ট্যভেদে অভয়াশ্রমের আয়তন কম-বেশি করা যাবে। তবে আয়তন ০১ বিঘার কম না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
  • অভয়াশ্রমের চারিপার্শ্বে অভয়াশ্রমের আয়তনের ২০-৩০% অতিরিক্ত স্থান 'নিরপেক্ষ স্থান' বা 'Buffer Zone' হিসেবে চিহ্নিত করে হলুদ পতাকা দ্বারা দৃষ্টিগ্রাহ্য করে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • প্রয়োজনে একই জলাশয়ে একাধিক অভয়াশ্রম স্থাপন করা যেতে পারে।

 

মৎস্য অভয়াশ্রমের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ/স্থাপন

  • জলমহালের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব যেমন- পলি ভরাট, নৌ-চলাচল ও কৃষি সেচে বাধার সৃষ্টি এবং জলমহালের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন উপকরণ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • জলাশয়ে স্থাপিত অভয়াশ্রম অংশে (closed area) নির্দিষ্ট সময়ে মাছ আহরণের উপর বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মৎস্য অভয়াশ্রম রক্ষা করার বিষয়টি অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে।
  • জলমহালের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের জন্য বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডালপালা, গাছের গুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে কাঠা স্থাপন করতে হবে।
  • পাড়ে দর্শনীয় স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থায়ী সাইন বোর্ড স্থাপন করতে হবে। অভয়াশ্রমের তীরবর্তী/পার্শ্ববর্তী সুবিধাজনকস্থানে "কমিউনিটি সেন্টার কাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র" স্থাপন করতে হবে।
  • প্রবাহমান জলাশয়ে বর্ষা মৌসুমে শুধুমাত্র মাছ ধরা বন্ধ রাখতে কম সংখ্যক বাঁশ ও ডালপালা ব্যবহার করা যাবে। প্রবাহহীন স্থির জলাশয় বা বিলে বাঁশ, ডালপালা, সিমেন্টের ত্রিপায়া জাতীয় অবকাঠামো ব্যবহার করা যাবে।
  • প্রতি বছর অভয়াশ্রম সংস্কার করতে হবে।

 

মৎস্য অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা

  • স্থায়ী অভয়াশ্রম হতে মাছ আহরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখতে হবে।
  • শুষ্ক মৌসুমে মৌসুমী অভয়াশ্রমেও মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। প্রয়োজনে পানি সেচ দিয়ে অভয়াশ্রমের মাছ সংরক্ষণ
  • করতে হবে।
  • প্রতিষ্ঠিত মৎস্য অভয়াশ্রম বিষয়ে জনবহুল স্থানে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারনা চালাতে হবে।
  • জেলা ও উপজেলা প্রশাসন হতে মৎস্য অভয়াশ্রম বিষয়ে পরিপত্রের (সার্কুলার) মাধ্যমে স্থানীয় অফিস-আদালত, জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অবহিতকরণ এবং এ বিষয়ে নিয়মিত গণসচেতনতামূলক সভা করতে হবে। প্রচলিত মৎস্য সংরক্ষণ আইন ও গৃহীত মৎস্য ব্যবস্থাপনা
  • পরিকল্পনার আলোকে অভয়াশ্রম এবং অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট জলাশয়ের মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রিত হবে।
  • স্থানীয়ভাবে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতির ব্রুড বা বড় পোনা মজুদ/ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এদের বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।

 

সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা

প্রতিটি জলাশয়ে সমাজভিত্তিক দল গঠনের মাধ্যমে অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা করতে হবে। প্রতিটি অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট জলাশয়ের তীরবর্তী/পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে একটি করে "গ্রাম মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি (VFCDC)" গঠন করতে হবে। VFCDC কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক এবং জলমহাল তীরবর্তী/পার্শ্ববর্তী এলাকার মৎস্যজীবী ও অন্যান্য স্বার্থ-সংশিষ্ট মহলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে (মৎস্যজীবী ৮০%, অন্যান্য ২০%) "জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি" (JMC) গঠন করতে হবে।

গ্রাম মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি (VFCDC) ১ জন সভাপতি, ১-২ জন সহ-সভাপতি, ১ জন সাধারণ সম্পাদক, ১-২ জন যুগ্ম সম্পাদক, ১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ১ জন কোষাধ্যক্ষ এবং ৩-৫ জন কার্যকরী সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি (JMC) ১ জন সভাপতি, ১-২ জন সহ- সভাপতি, ১ জন সাধারণ সম্পাদক, ১-২ জন যুগ্ম সম্পাদক, ১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ১ জন কোষাধ্যক্ষ এবং ৫-১৩ জন কার্যকরী সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে।

 

সচেতনতা বৃদ্ধি

  • জনবহুল স্থানে যেমন- হাট-বাজার, মেলা, স্থানীয় বাজার, পাড়া-মহল্লা ইত্যাদিতে মাইকিং, পোস্টারিং ও সচেতনতামূলক সভা প্রভৃতির মাধ্যমে অভয়াশ্রম সম্বন্ধে কার্যকর প্রচার করতে হবে।
  • সভা, সমাবেশ, পোষ্টার, লিফলেট, পত্রিকা, বিলবোর্ড স্থাপন, পথনাটক, রেডিও, টিভি, ফিলার, জিঙ্গেল ইত্যাদির যেটি যেখানে সম্ভব সেটি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মৎস্য অভয়াশ্রম বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • উপজেলা মৎস্য অফিস ছাড়াও জেলা ও উপজেলা প্রশাসন হতে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন সংক্রান্ত প্রচারপত্রের মাধ্যমে মৎস্যজীবী, অভয়াশ্রম সংলগ্ন এলাকাবাসী, স্থানীয় অফিস, জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক ও সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিগণকে অবহিত করতে হবে।

 

পরিবেশ সংরক্ষণ

অভয়াশ্রম স্থাপনে এমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না বা এমন কোন সামগ্রী ব্যবহার করা যাবে না যা সামগ্রিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার করে অভয়াশ্রম স্থাপনকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

 

মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন/নির্মাণ ব্যয় সংক্রান্ত নির্দেশাবলী

মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন/নির্মাণে অভয়াশ্রমের আয়তনের উপর ভিত্তি করে ব্যয় নির্ধারণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

  • মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন/নির্মাণে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এবং দামেবংস্তা অথচ কার্যকর এ ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে।
  • বাফার জোন ছাড়াও স্থাপিত অভয়াশ্রমের চারদিকের সীমানায় মোটা বাঁশের খুঁটির উপর লাল পতাকা লাগিয়ে সীমানা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে।
  • শুধুমাত্র প্রথমবার কর্মসূচি/প্রকল্প হতে বরাদ্দ মোতাবেক অভয়াশ্রম স্থাপনের ব্যয় নির্বাহ করা হবে। পরবর্তী বছরগুলোতে সুফলভোগীগণকে অভয়াশ্রম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হবে।

 

উপজেলা পর্যায়ে অভয়াশ্রম স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিটি

সংশ্লিষ্ট উপজেলায় মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রধান উপদেষ্টা এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে দুই সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শাখা-৪ কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্র নং- মপম/ম- ৪/মঃসঃবৃঃ-১/২০০৮/৪৪৩; তাং ০৩/১২/২০০৮ খ্রি. অনুযায়ী গঠিত "উপজেলা মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি" অভয়াশ্রম স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। এ কমিটি গ্রাম মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি এবং জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রম মনিটর করবে।