একোয়াপনিক গার্ডেনিং এর মাধ্যমে নিরাপদ মাছ ও সবজি উৎপাদন
একোয়াপনিক পদ্ধতি হলো সমন্বিত মাছ ও সবজি চাষ যেখানে মাছ চাষে ব্যবহৃত পানি গাছের পুষ্টির যোগান দেয় এবং রি-সারকুলেটরি পদ্ধতিতে সেই পানি পরিষ্কার হয়ে মাছ চাষে ব্যবহৃত হয়। মাছ, ব্যাকটেরিয়া এবং গাছ এই তিনটি রি-সারকুলেটরী পদ্ধতির উপাদান যেখানে মাটি ছাড়া গাছ/সবজি উৎপাদিত হয়। এই পদ্ধতিতে ড্রাম বা ট্যাংকে মাছ চাষ করা হয় এবং মাছের মর-মূত্র ও মাছে সরবরাহকৃত খাদ্য ব্যাক্টেরিয়াল পঁচন ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের জন্য পুষ্টি তৈরি হয়। একোয়াপনিক পদ্ধতি দেশের শহরাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।
একোপনিক পদ্ধতির কাযর্প্রণালী
একোয়াপনিক পদ্ধতিতে দুইটি প্রধান অংশ বিদ্যমান যেমন-একোয়াকালচার অর্থাৎ মাছের চাষ এবং হাইড্রোপনিক অর্থাৎ গাছের (সবজি) চাষ। মাচ চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত খাদ্য ও মাছের দেহ হতে উৎপাদিত বর্জ্য (যেমন NH3) মাছের স্বাস্ত্যের জন্য হানিকর। আবার এই বর্জ্য পদার্থ ব্যাক্টেরিয়াল পঁচন ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের জন্য পুষ্টি (NH3 ভেঙ্গে N2) তৈরী করতে সক্ষম।
একোয়াপনিক পদ্ধতির উপাদানসমূহ
১. একোয়াকালচার সিষ্টেম/মাছ চাষের ট্যাংক : মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন আকারের ট্যাংক ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন গোলাকার বা আয়তাকার অথবা বর্গাকৃতি। এই ট্যাংকের ভিতর পানি দিয়ে মাছ চাষ করা যায় এবং চাষের জন্য এক ঘনমিটার থেকে বেশি আয়তনের ট্যাংক উপযোগী।
২.বায়োফিল্টার : এটা এমন একটি সিস্টেম যেখানে নাইট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া মাছের ট্যাংকে উৎপাদিত বর্জ্য হতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান তৈরি করে। নুড়ি পাথর, মোটা বালি ও ঝিনুকের খোলস দিয়ে বায়োফিল্টার তৈরি করা হয়।
৩. হাইড্রোপনিক সিস্টেম/সবজি চাষের ট্রে : হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেমে মাটির পরিবর্তে পানিতে সবজি চাস করা হয়। এমএস সীটের ট্রে, ফাইবার গ্লাস ট্রে অথবা কংক্রিটের ট্রে সবজি চাষের জন্য উপযোগী। এখানে সবজি তার শিকড়ের মাধ্যমে বায়োফিল্টার হতে আগত পানি থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহন করে বৃদ্দি প্রাপ্ত হয় এবং পানিকে পরিশোধনের মাধ্যমে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলে।
৪. সাম্প ট্যাংক : এটি একটি ট্যাংক যেখানে হাইড্রোপনিক সিস্টেম বা সবজির ট্রের পানি অভিকর্ষজ শক্তির মাধ্যমে জমা হয় এবং এই পানি পাম্পের সাহায্যে মাছের ট্রেতে পুনরায় ফিরে আসে।
৫. পাম্প ও অক্সিজেন সরবরাহকারী সরজ্ঞাম : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে ০.৫ হর্স পাওয়ারের পাম্প ব্যবহার করা হয় যা পানি উত্তোলনের কাজে সহায়তা করে। মাছের ট্যাংকে এবং সবজির ট্রেতে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য ছোট এরেটর বা এয়ার ব্লোয়ার বা এয়ার কমপ্রেসার ব্যবহার করা যেতে পারে।
নাইট্রিফিকেশন ও পুষ্টি উপাদান : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে এ্যারোবিক কনভারশনের মাধ্যমে অ্যামোনিয়া নাইট্রেটে পরিবর্তিত হয় যা এই পদ্ধতির অন্যতম প্রধান কাযর্ক্রম। মাছে ব্যবহৃত অতিরিক্ত খাদ্য, মাছের মল-মূত্র হতে অ্যামোনিয়া উৎপাদিত হয় যা আবশ্যিকভাবে ফিল্টার করা দরকার। Nitrosomas ব্যাকটেরিয়া অ্যামোনিয়া ভেঙ্গে নাইট্রাইট এ পরিণত করে যা পরবর্তিতে Nitrobacter ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে নাইট্রেটে পরিণত হয়। নাইট্রেট গাছের পুষ্টি সরবরাহে কাযর্করী ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে ক্যালসিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড ব্যবহার করা হয় যা পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে।
সবজি ও মাছ উৎপাদন : একোয়াপনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। গিফট তেলাপিয়া, থাই কৈ, ভিয়েতনামী কৈ, সরপুঁটি এবং যে সকল মাছ ট্যাংকে চাষ করার উপযুক্ত সে সব মাছ চাষ করা যায়। ঢেড়স, পুঁইশাক, কলমি, পুদিনা, টমেটো, লেটুস, স্ট্রবেরী ইত্যাদি জাতের সবজি ও ফল চাষ করা যায়। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পযর্ন্ত সময়ে শীতকালীন সবজি ও মাছ উৎপাদন করা যায়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পযর্ন্ত সময়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও মাছ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
গাছের চারা রোপন : হাইড্রোপনিক ট্রেতে ককসিট স্থাপন করা হয় এবং ককসিটে সবজির জাত অনুযায়ী ছিদ্র করে স্পঞ্জ দিয়ে চারা রোপন করা হয়। জাত ভেদে প্রতি বর্গমিটারে ৯-২৭ টি চারাগাছ রোপন করা হয়।
মাচের পোনা মজুদ ও খাদ্য প্রয়োগ : একোয়াকালচার সিস্টেমে ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া মাছ প্রতিঘন মিটারে ৬০ টি ও প্রতিঘন মিটারে ৮-১০ গ্রাম ওজনের ১০০-১২০ টি থাই কৈ মাছ মজুদ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার হাইড্রোপনিক ট্রের জন্য প্রতিদিন ৮০-১০০ গ্রাম খাবার প্রয়োগ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে ১২০ দিনে প্রতি ঘন মিটারে ৭-৮ কোজ তেলাপিয়া উৎপাদিত হয়ে থাকে।
ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছের চাষ
বিগত কয়েক বছর হতে আমাদের দেশে বিভিন্ন নদ-নদীতে খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ হচ্ছে। মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট এর স্বাদুপানি কেন্দ্র হতে গুলশা মাছ খাঁচায় চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। সহনশীর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাসমান খাঁচায় উচ্চমূল্যের গুলশা মাছ চাষ করে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টির অভাব পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
খাঁচায় পোনা মজুদকরণ
খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা
দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নদীতে খাঁচা স্থাপন করে বিলুপ্ত প্রায় গুলশা মাছ সহজে চাষ করা যায়। ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষ করে প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৯-১০ কেজি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মাছ একত্রে আহরণ অপেক্ষা ৪-৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ৬ মাস পযর্ন্ত বেছে বেছে বড় মাছ আহরণ করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়।