ভূমিকা:
কোয়েল পালন বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্পে এক নতুন সংযোজন। কোয়েল ছোট আকারের গৃহপালিত পাখি। পোল্ট্রির অনেক প্রজাতির মধ্যে কোয়েল একটি। অন্যান্য পোল্ট্রির তুলনায় কোয়েলের মাংস এবং ডিম গুণগতভাবে শ্রেষ্ঠ। বাড়ীর আঙ্গিনায়, ঘরের কোণে ১০-২০ টা কোয়েল সহজেই পালন করা যায়। কোয়েল পাখি প্রতিপালন করে পারিবারিক পুষ্টি যোগানোর সাথে সাথে অতিরিক্ত কিছু আয় করা সম্ভব।
কোয়েল পালনের সুবিধা:
১. কোয়েল দ্রুত বর্ধনশীল,
২. অল্প বয়সে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে এবং ৬-৭ সপ্তাহে ডিম পাড়া শুরু করে,
৩. সঠিক যতেœ এবং ব্যবস্থাপনায় বছরে ২৫০-২৬০টি ডিম পাড়ে,
৪.ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং প্রোটিনের ভাগ বেশি,
৫. অন্যান্য পোল্ট্রির দৈহিক ওজনের তুলনায় কোয়েলের ডিমের শতকরা ওজন বেশি।
৬. একটি মুরগির জায়গায় ৮-১০টা কোয়েল পালন করা যায়,
৭. মাত্র ১৭-১৮ দিনে কোয়েলের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়,
৮. বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের উপযোগী,
৯. রোগ বালাই কম এবং খাবার খুবই কম লাগে
১০. অল্প বয়সে পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প দিনে বেশি লাভ করা যায়।
স্ত্রী এবং পুরুষ কোয়েল চেনা:
স্ত্রী কোয়েলের পেট নরম এবং ডিম অনুভূত হয়। পুরুষ কোয়েলের পেটে হাত দিলে ভেন্ট দিয়ে সাদা ফোমের মত তরল পদার্থ নির্গত হয়।
পুনরুৎপাদন:
শুধুমাত্র ডিম ফুটাতে চাইলে স্ত্রী এবং পুরুষ কোয়েল একত্রে রাখার প্রয়োজন। ডিমের জন্য স্ত্রী কোয়েল পালন অধিক লাভজনক। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে ৩:১ অনুপাতে অপেক্ষাকৃত ভাল। স্ত্রী কোয়েলের সাথে পুরুষ কোয়েল রাখার ৪ দিন পর থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা উচিৎ। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কোয়েল ৬-৭ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম বছর গড়ে ২৫০-৩০০টি ডিম পাড়ে। ডিমপাড়া শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহের ডিম বাচ্চা ফুটানোর জন্য বসানো উচিত নয়। ৫০ সপ্তাহের অধিক বয়সের কোয়েলের ডিমের উর্বরতা এবং ফোটার হার কম। কোয়েল এক বাণিজ্যিক বৎসরের অধিককাল পালন করা উচিত নয়। আন্তঃ প্রজনন যাতে না হয় সে জন্য নিকট সম্পর্কযুক্ত কোয়েলের মধ্যে মিলন ঘটানো যাবে না।
ইনকিউবেটরে বসানোর পূর্বে ডিমের যত্ন:
দিনে অন্ততঃ দুইবার ফোটানোর ডিম সংগ্রহ করতে হবে এবং ১৫.৫০ সে. তাপমাত্রায় ৮০% আর্দ্রতায় ৭-১০ দিন সংরক্ষণের জন্য ২০ মিনিট ফরমালডিহাইড গ্যাসে রাখতে হবে। ময়লাযুক্ত ডিম, রোগ ও জীবাণুর প্রধান উৎস। কাজেই সর্বদা ভাল পরিষ্কার পরিছন্ন ডিম ফুটানোর জন্য বসাতে হবে। ফুটানোর ডিম ধোয়া উচিত নয়।
ইনকিউবেটরে ডিমের ব্যবস্থাপনা:
স্বাভাবিক নিয়মে ১৭-১৮ দিনে কোয়েলের ডিম থেকে উপযুক্ত পরিবেশে বাচ্চা ফুটে। কোয়েলের ডিম সাধারণত কৃত্রিম উপায়ে ইনকিউবেটর দিয়ে ফোটানো হয়। সফলভাবে বাচ্চা ফোটানোর হার বেশি পেতে হলে ইনকিউবেটরের নির্মাতার নির্দেশ সতর্কতার সাথে অবলম্বন করতে হবে।
ইনকিউবেটরে কিছু কিছু মডেল শুধুমাত্র কোয়েলের ডিম বসানোর জন্যই ডিজাইন করা হয়। কোয়েলের ডিম মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহৃত ইনকিউবেটরে ফোটানো যেতে পারে। তবে ডিম বসানোর ট্রে-গুলোতে কিছুটা পরিবর্তন আনা দরকার। নিয়মমাফিক কোয়েলের ডিম প্রথম ১৫ দিন সেটিং ট্রেতে এবং পরবর্তী ৩ দিন হ্যাচিং ট্রেতে দিতে হবে। তাপমাত্রা ৯৮-১০১০ ফা. এবং প্রথম ১৫ দিন ৫০-৬০% আর্দ্রতা এবং পরবর্তীতে ৬০-৭০% আর্দ্রতা রাখা ব্যঞ্জনীয়। প্রতি ২ থেকে ৪ ঘন্টা অন্তর অন্তর ডিম ঘুরিয়ে (টার্নিং) দিতে হবে যাতে এমব্রায়ো খোসার সাথে লেগে না যায়। ১৫তম দিনে ডিম সেটিং ট্রে থেকে হ্যাচিং ট্রেতে স্থানান্তর করতে হবে এবং ডিম ঘুরানো বন্ধ করতে হবে। ডিম থেকে বের হওয়া বাচ্চা ২৪-২৮ ঘন্টার মধ্যে ব্রæডার ঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে।
কোয়েলের বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা ও যত্ন:
বাচ্চাকে তা দেওয়া বা ব্রুডিং খাঁচায় বা কেজে করা যায়। বাংলাদেশে গরমের সময় দুই সপ্তাহ এবং শীতের সময় তিন-চার সপ্তাহ কৃত্রিম উপায়ে তাপ দিতে হয়। গবেষণা থেকে জানা যায় যে, দুই সপ্তাহ কেজে ব্রæডিং করে পরবর্তীতে মেঝেতে পালন করলে বাচ্চার মৃত্যু হার অনেক কম এবং বাচ্চার ওজন অপেক্ষাকৃত বেশী হয়। ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্রæডিং ঘরে বাচ্চা স্থানান্তর করতে হবে এবং প্রথমে গøুকোজ পানি এবং পরে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্যের সাথে পর পর তিন দিন গøুকোজ পানি খেতে দেয়া ভাল। প্রথম ২-১ দিন খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে এবং প্রতিদিন খবরের কাগজ পরিবর্তন করতে হবে। এর পর ছোট খাবার পাত্র বা ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রথম সপ্তাহ |
দ্বিতীয় সপ্তাহ |
তৃতীয় সপ্তাহ |
চতুর্থ সপ্তাহ |
৩৫০ সে. (৯৫০ ফা.) |
৩২. ২০ সে. (৯০০ ফা.) |
২৯.৫০ সে. (৮৫০ ফা.) |
২৭.৬০ সে. (৮০০ ফা.) |
বাসস্থান:
বাণিজ্যিকভাবে কোয়েল পালনের জন্য লিটার পদ্ধতির চেয়ে কেইজ পদ্ধতি অধিক লাভজনক। মেঝে এবং খাঁচায় দুই পদ্ধতিতে কোয়েল পালন সু-প্রতিষ্ঠিত। বাচ্চা অবস্থায় প্রতিটি কোয়েলের জন্য খাঁচায় ৭৫ ব. সে. মি. এবং মেঝেতে ১০০ ব. সে. মি. জায়গার দরকার। অন্যদিকে বয়স্ক কোয়েলের বেলায় খাঁচায় প্রতিটির জন্য ১৫০ ব. সে. মি. এবং মেঝেতে ২৫০ ব. সে. মি. জায়গা প্রয়োজন। দুইটি ডিম পারা কোয়েলের জন্য একটি ১২.৭২০.৩ সে. (৫৮ ইঞ্চি) মাপের কেইজ যথেষ্ট।
খাঁচায় কোয়েল পালন:
খাঁচায় ৫০টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১২০ সে. মি. দৈর্ঘ্য, ৬০ সে. মি. প্রস্থ এবং ৩০ সে. মি. উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচার প্রয়োজন। খাঁচার মেঝের জালিটি হবে ১৬-১৮ গেজি। ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চার খাঁচার মেঝের জালের ফাঁক হবে ৩ মি. মি. ৫ মি. মি. এবং বয়স্ক কোয়েলের খাঁচায় মেঝের জালে ফাঁক হবে ৫ মি. মি. ৫ মি. মি. খাঁচার দুই পাশের্^ একদিকে খাবার পাত্র অন্যদিকে পানির পাত্র সংযুক্ত করে দিতে হবে
খাবার পাত্র:
বাচ্চা অবস্থায় ফøাট ট্রে বা ছোট খাবার পাত্র দিতে হবে যেন খাবার খেতে কোন রকম অসুবিধা না হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রতি ২৮টি বাচ্চার জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫০ সে.মি. প্রস্থ ৮ সে.মি. এবং উচ্চতা ৩ সে.মি. এবং প্রতি ৩৪টা বয়স্ক কোয়েলের জন্য একটি খাবার পত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫৭ সে.মি. প্রস্থ ১০ সে.মি. এবং উচ্চতা ৪ সে.মি.) ব্যবহার করা যায়। দিনে দুইবার বিশেষ করে সকালে এবং বিকালে খাবার পাত্র ভাল করে পরিষ্কার সাপেক্ষে মাথা পিছু দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম খাবার দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, প্রথম সপ্তাহ থেকে ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে বাড়িয়ে ২০-২৫ গ্রাম পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
পানির পাত্র:
সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলে জন্য ০.৬ সে.মি. (১/৪ ইঞ্চি) পানির পাত্রের জায়গা দিতে হবে। প্রতি ৫০ টা কোয়েলের জন্য একটি পানির পাত্র দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রতি ৫টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১টি নিপল বা কাপ ড্রিংকার ব্যবহার করা যেতে পারে।
লিটার এবং ইহার ব্যবস্থাপনা:
তুষ, বালি, ছাই, কাঠের গুড়া প্রভৃতি দ্রব্যাদি কোয়েলের লিটার হিসেবে মেঝেতে ব্যবহার করা যায়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তুষ উপযোগী এবং সহজলভ্য। মেঝেতে ডিম লিটার পদ্ধতি অবলম্বন করা শ্রেয়।
প্রথমেই ৫-৬ ইঞ্চি পুরু তুষ বিছিয়ে দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন লিটার ভিজা না হয়। লিটারের শতকরা ১-২ ভাগ চুন মিশিয়ে দিতে হবে যেন লিটার শুষ্ক ও জীবাণুমুক্ত হয়।
আলোক ব্যবস্থাপনা:
কাঙ্খিত ডিম উৎপাদন এবং ডিমের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য দৈনিক ১৪-১৮ ঘন্টা আলোক প্রদান করা প্রয়োজন । শরৎকালে এবং শীতকালে দিনের আলোক দৈর্ঘ্য কম থাকে তাই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পুরুষ কোয়েল যেগুলো প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং যেগুলো শুধুমাত্র মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোর জন্য দৈনিক ৮ ঘন্টা আলোই যথেষ্ট। নি¤œ সারণী মোতাবেক আলোক দিলে কাম্য ডিম উৎপাদন সম্ভব।
৫ সপ্তাহ |
৬সপ্তাহ |
৭ সপ্তাহ |
৮ সপ্তাহ |
৯ সপ্তাহ |
১০ সপ্তাহ |
১১ সপ্তাহ |
১২ সপ্তাহ |
১২:০০ |
১২:০০ |
১৩:৩০ |
১৩:৩০ |
১৪:৩০ |
১৪:৩০ |
১৫:০০ |
১৬:০০ |
সুষম খাদ্য:
কোয়েলের রেশনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: স্টার্টার (০-৩ সপ্তাহ), বাড়ন্ত কোয়েলের প্রতি কেজি খাবারে ২৭% প্রোটিন এবং ২৮০০ কিলোক্যালোরি বিপাকীয় শক্তি; ডিমপাড়া কোয়েলের প্রতি কেজি খাবারে ২.৫-৩% ক্যালসিয়াম থাকতে হবে।
বয়স |
খাদ্যের প্রকার |
প্রোটিন% |
বিপাকীয় শক্তি |
০-৩ সপ্তাহ |
স্টার্টার ম্যাশ |
২৭% |
২৮০০ শপধষ/শম |
৪-৫ সপ্তাহ |
বাড়ন্ত ম্যাশ |
২৩% |
২৭০০ শপধষ/শম |
০-৬ সপ্তাহ |
লেয়ার এবং ব্রিডার ম্যাশ |
২২-২৪% |
২৫০০-২৭০০ শপধষ/শম |
রোগ:
কোয়েলের রোগবালাই নেই বললেই চলে। তবে বাচ্চা ফোটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ সংকটপূর্ণ। এ সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোয়েলের বাচ্চার যতœ নিতে হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায় তবে বয়স্ক কোয়েলের মৃত্যুহার খুবই কম।
উপসংহার:
উৎপাদনের দিক থেকে কোয়েল অধিক উৎপাদনশীল। অল্প জায়গায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কম খরচে পারিবারিক পর্যায়ে অথবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালন দেশে পুষ্টি ঘাটতি মিটাতে এবং জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম