মৎস্য খাতে ঋণ প্রাপ্তির সহজ নিয়মাবলী

মৎস্য খাতে ঋণ প্রদান কর্মসূচি

Jakia sultana | ০৮ মে ২০২৪

আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মৎস্য খাত একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে পুকুরে মৎস্য চাষ ও চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ একান্ত অপরির্হায। মৎস্য চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যথেষ্ট কম। এর অন্যতম কারণ উদ্যোক্তা ও পুকুর মালিকদের অর্থাভাব। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা অনুসরণের মাধ্যমে কৃষি ঋণের পাশাপাশি মৎস্য চাষের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ প্রদান করে আসছে।

বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন ঋণ কর্মসূচির বিবরণ:

মৎস্য খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ঋণ কর্মসূচি চালু আছে। নিন্মে উল্লেখযোগ্য ঋণ কর্মসূচির বিবরন প্রদান করা হলো:

(ক) পুকুর মৎস্যচাষ ঋণ কর্মসূচি : পুকুর সংস্কারসহ বিদ্যমান পুকুরে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে মাছ চাষে উৎসাহিত করে মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য। এ কাযর্ক্রমটি রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ যথা: সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক কর্তৃক সারা দেশব্যাপী বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ঋণের বিবরণ নিন্মে প্রদান করা হলো:

ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা: পুকুরের মালিক, ইজারাদার, যৌথমালিকানাধীন পুকুরের অংশীদারগণ হতে মোক্তারনামা বা সম্মতি পত্র প্রাপ্ত অংশীদারগণ আবেদনের যোগ্যতা রাখে।

আবেদন পত্র দাখিল: আগ্রহী প্রার্থিীগণকে ব্যাংক শাখা/স্থানীয় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার অফিস থেকে ঋণের আবেদনপত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। আবেদনপত্র যথাযথভাবে পূরণ করার পর উপজেরা মৎস্য কর্মকর্তার নিকট দাখিল করতে হবে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবেদনপত্র পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পুকুরের কারিগরি সম্ভাব্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন এবং সরেজমিনে পুকুর তদন্ত শেষে কারিগরি সম্ভাব্যতা সন্তোষজনক হলে ও মালিকানা যথার্থ মনে হলে আবেদনপত্রে সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখায় পাঠাবেন।

ঋণ মঞ্জুর ও জামানত : প্রাপ্ত আবেদনপত্র এবং সংশ্লিষ্ট দলিলপত্রাদি ব্যাংক কর্তৃক পরীক্ষা করা হবে। প্রয়োজনে একক বা যৌথভাবে পুকুর পরিদর্শন করবেন। ঋণ মঞ্জুরীর পর জামানত সংক্রান্ত ও অন্যান্য চুক্তিপত্র সম্পাদনান্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সোনালী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এই ঋণের ক্ষেত্রে ৫০,০০০/- টাকা পযর্ন্ত কোন সহায়ক জামানত প্রয়োজন হয় না। ৫০,০০০/- টাকার উর্ধ্বে ঋণের জন্য পুকুর জামানত হিসেবে ব্যাংকের নিকট বন্ধক থাকবে।

সুদের হার: এই ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারবর্তমান সুদনীতি অনুযায়ী স্ব স্ব ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হবে। খেলাপী ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখের পরের দিন থেকে ব্যাংকসমূহ ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে নির্ধারিত হারে সুদ আদায় করবে।

ঋণ পরিশোধের মেয়াদ: ১৮ মাস পর ঋণ পরিশোধ শুরু হবে এবং ঋণ গ্রহতিা ৪ টি সমান বার্ষিক কিস্তিতে সম্পূর্ণ সুদসহ ঋণ পরিশোধ করবে।

(খ) মাছচাষের জন্য ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ ব্যবস্থা: মৎস্যচাষিগণকে মহায়তা করার লক্ষ্যে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেরাই মৎস্য চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই পূর্বক ঋণের পরিমাণ, বিতরণ খাত, ঋণের মেয়াদ ও পরিশোধের কিস্তি নির্ধারণ করে ঋণ বিতরণ করে থাকে। সাধারণত যারা বেশি অংকের ঋণের জন্য আবেদন করে থাকেন তারাএ ই ক্যাটাগরির ঋণ পেয়ে থাকেন।

(গ) সাধারণ ঋণ কর্মসূচির আওতায় পল্লী ঋণ: শিক্ষিত বেকার যুবক/যুব মহিলা এই কমর্সূচির আওতায় ঋণ পেয়ে থাকেন। এই ঋণ প্রদানের সাধারণ নিয়মগুলো নিন্ম প্রদান করা হলো:

ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা: শিক্ষিত বেকার যুবক/যুব মহিলা এই কমর্সূচির আওতায় ঋণ পাবার যোগ্য, তবে মৎস্য চাষের উপর তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। ঋণ গ্রহণের জন্য গ্রুপ গঠনের প্রয়োজনর হবে। যে সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে না তা গ্রুপের নামে লীজ গ্রহণ করতে হবে।

ঋণের জামানত: এই ঋণের জন্য অতিরিক্ত কোন জামানত প্রয়োজন হবে না। তবে ৫০,০০০/- টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে কমপক্ষে সমপরিমাণ সহায়ক জামানতের প্রয়োজন হবে।

ঋণ পরিশোধের মেয়াদ: পুকুরে মাছচাষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যয় ব্যাংক ঋণ থেকে মেটানো হবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হবে ৫ বছর।

ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি: প্রতিবার মাছ ধরার সময় বিক্রিত মাছের মূল্যের ৫০% ঋণের হিসাবে জমা হবে যতদিন না সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ হয়। বিক্রিত মাছের ৫০% টাকা গ্রুপ সদস্যরা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারবে। ব্যাংকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পুকুরের মাছ ধরা এবং বিক্রিত হবে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণ কর্মসূচির প্রচলিত নীতিমালা প্রায় একই ধরণের। কিন্তু ব্যাংকভেদে বিত্যমান ঋণ সীমা ভিন্নতর। বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহের ঋণ কর্মসূচির খাত সমূহ ও ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নিন্মে প্রদান করা হলো :

ব্যাংকের নাম

            খাতসমূহ

         বিদ্যমান ঋণসীমা

 সুদের হার

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক

পুকুরে মৎস্যচাষ

বিঘাপ্রতি ২১,৩০০/- টাকা

      ৮%

উপকূলীয় এলাকায় স্বল্প মেয়াদী ঋণ কর্মসূচি

প্রতি ১০ একর চাষের জন্য ১,৮১,০০০/- টাকা হতে ১,৮৬,০০০/-

 

উন্নত ব্যাপক পদ্ধতিতে গলদা চাষের ঋণদান কর্মসূচি

একর প্রতি ৬০,০০০/- টাকা হিসেবে ১,৫০,০০০/- টাকা ২.৫০ একরের জন্য

উন্নত সনাতন পদ্ধতি

 

একর প্রতি ২০,০০০/- টাকা হিসেবে জমির পরিমাণের উপর

পুকুরে মধ্য মেয়াদি মাছের চাষ

মূলধন ব্যয় ৩৭,০০০/- টাকা + বিভিন্নপ্রজাতির মাছের জন্য আলাদা নতিমালা

সোনালী ব্যাংক

 

 

 

পুকুরে মৎস্যচাষ

 

একর প্রতি ৭৫,০০০/- টাকা

৮%

 

 

 

 

 

 

 

 

চিংড়ি চাষ

-সনাতন পদ্ধতি

-উন্নত পদ্ধতিতে

-সনাতন পদ্ধতিতে

 

 

একর প্রতি ২৪,৭০০/- টাকা

একর প্রতি ১,৩৮,২৯৮/- টাকা

১,৬৯,২০০/- টাকা ( ১০ একরের জন্য)

এক একর পুকুরে কার্প জাতীয় মাছের পোনা চাষ

-এক ধাপ পদ্ধতিতে

-দুই ধাপ পদ্ধতিতে

 

 

 

৩৪,৪২৬/- টাকা

৭৫,৮৮০/- টাকা

 

 

ব্যাংকের নাম

            খাতসমূহ

         বিদ্যমান ঋণসীমা

    সুদের হার

অগ্রণী ব্যাংক

পুকুরে মৎস্যচাষ

(সর্বোচ্চ এক একর পুকুরের জন্য)

-পুকুর পুনঃখনন

-পানি নিষ্কাশন ও উপকরণ বাবদ

 

 

 

বিঘাপ্রতি ১৫,০০০/- টাকা

বিঘাপ্রতি ২,২০০/- টাকা

      ৯-১০%

মোট=১৭,২০০/- টাকা

জনতা ব্যাংক

পুকুরে মৎস্য চাষ

-পুকুর সংস্কার

-পুকুর প্রস্তুতি

-পোনা ক্রয়, উপকরণ ও অন্যান্য ব্যয়

 

 

একর প্রতি ১০,০০০/- টাকা

একর প্রতি ১০,০০০/- টাকা

একর প্রতি ৩০,০০০/- টাকা

 

       ৯-১০%

 

      মোট=৫০,০০০/- টাকা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

(ঘ) মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঋণ প্রদান কর্মসূচি

ঘ.১। সমন্বিত মৎস্য কাযর্ক্রমের মাধ্যমে দিারিদ্র বিমোচন প্রকল্প

গ্রামীণ দরিদ্র চাষী, মৎস্যজীবি, বেকার যুবক ও দুঃস্থ মহিলাদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত মৎস্যচাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এই প্রকল্প থেকে মৎস্যচাষে ঋণ প্রদান করা হয়।

ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা

গ্রামীণ দরিদ্র চাষী, মৎস্যজীবি, বেকার যুবক, দুঃস্থ মহিলা, প্রান্তিক চাষী যাদের বাড়ির ভিটা ছাড়া সর্বোচ্চ ১ বিঘা জমি আছে এবং নিজস্ব অথবা ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে পুকুরের মালিক এ ঋণ পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

ঋণের জামানত

এ ঋণ পাওয়ার জন্য কোন জামানত দিতে হয় না। তবে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে ১৫০/- টাকার নন-জুডেশিয়াল ষ্ট্যাপের উপর একটি চুক্তিনামা করতে হবে।

ঋণের পরিমাণ

জলাশয়ের আয়তনের উপর নির্ভর করে একর প্রতি ৪০,০০০/- টাকা এবং সর্বোচ্চ ১,০০,০০০/- টাকা পযর্ন্ত ঋণ প্রদান করা হয়।

ঋণ পরিশোধ পদ্ধতি

ঋণের আসল টাকা পাঁচ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। ১ম বছর ঋণের আসল টাকার ১৫% পরবর্তী ৪ বছর যথাক্রমে আসলের ২৫%, ২৫%, ২৫% ও ১০% হারে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

 

সার্ভিস চার্জ

ঋণের আসল টাকার উপর ৫% হারে সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হবে।

ঘ.২। মৎস্য সেক্টরে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি

দেশের জলজ ও প্রাণিজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, স্বল্প জায়গায় ও অল্প পুঁজিতে মাছচাষ করে গ্রামীণ অথর্নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা

সুফল ভোগীকে এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। সুফলভোগীকে নিজস্ব/ইজারার মাধ্যমে কমপক্ষে ২০ শতাংশ জলাশয়ের ভোগ দখলদার হতে হবে। একক অথবা গ্রুপভিত্তিক (একের অনধিক ৩ জন) ব্যক্তিগণ ঋণ পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

ঋণ অনুমোদন পদ্ধতি

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এলাকার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির সহযোগিতায় উৎসাহী মৎস্য চাষীদের মধ্য থেকে কায নির্দেশিকার আলোকে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করে উপজেলা কমিটির নিকট উপস্থাপন করবেন। উপজেলা কমিটি অর্থ ছাড়ের জন্য অনুমোদিত প্রকল্পের একটি তালিকা মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর এবং জেলা কমিটির বরাবরে প্রেরণ করবেন। মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর অগ্রাধিকার ও অর্থের সংকুলাস সাপেক্ষে উপজেলা কমিটির অনুকূলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করবেন।

ঋণের পরিমাণ

জলাশয় সংস্কার/লিজ/অবকাঠামো তৈরির জন্য ৩৭৫০/- টাকা হতে ১০,০০০/- টাকা। উপকরণ যথা- চুন, পোনা, সার, খাদ্য ইত্যাদি বাবদ ৯৩৭৫/- হতে ২৫,০০০/- টাকা। মাছচাষ অতিরিক্ত আয় বর্ধনমূলক কাযর্ক্রম বাবদ আনুমানিক ১৯৭৫/- টাকা হতে ৫০০০/- টাকা। ১.০০ (এক) লক্ষ টাকার অধিক কোন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।

ঋণের জামানত

এ ঋণ সম্পূর্ণ জামানতবিহীন। কেবল ঋণ গ্রহীতাকে নির্ধারিত নীতিমালা পালনের জন্য একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করতে হবে।

সার্ভিস চার্জ

ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে প্রদত্ত ঋনের উপর শতকরা বার্ষিক ৭% হারে সার্ভিস চার্জ আদায় করা হবে। ঋণের আদায়কৃত সমুদয় অর্থ (আসল ও সার্ভিস চার্জ) কর্মসূচির ব্যাংক তহবিলে জমা রাখতে হবে।

যোগাযোগ

অনেকেই ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত নন। তাই ঋণ বিতরণ ও গ্রহণ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা ও ঋণ গ্রহণকারী ব্যাংক সমূহের সাতে যোগাযোগ করুন।