এদেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় পুঁটি, মলা, ঢেলা,কৈ, শিং, বাইম, ভাগনা, বাটা, গনিয়া ইত্যাদি ছোট মাছ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ সমস্ত মাছের মধ্যে গনিয়া খুবই সুস্বাদু মাছ। আঞ্চলিকভাবে এটি ঘুনিয়া, ঘাইন্না কিংবা গৈন্না নামে পরিচিত। মাছটি সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা বেশি এবং বাজারমূল্যে রুই জাতীয় মাছের তুলনায় বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাছটির ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে গনিয়া মাছটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু পোনার অপ্রতুলতার জন্য এখন পর্যন্ত মাছটি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সেইসাথে সুস্বাদু এই মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষাও করা যেতে পারে। সম্প্রতি বিপন্ন প্রজাতির এ মাছ নিয়ে গবেষণায় কৃত্রিম প্রজনন, পোনা লালন- পালন এবং চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
প্রজনন কৌশল : গনিয়া মাছ মূলত নদীর মাছ। তাই বর্ষাকালে নদ- নদীতেই প্রজনন করে থাকে। সাধারণত দক্ষিণ- পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবাহের সময়কালে এরা প্রজনন করে ও ডিম দেয়। ভারি বৃষ্টির পর পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম দেয় এবং ডিম দেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ডিম ফুটে রেণু বের হয়ে আসে। এদের ডিম ভাসমান প্রকৃতির। এ মাছটি মে মাস থেকে শুরু করে জুলাই মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। কিন্তু জুন মাস মাছটির প্রজননের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়।
পরিপক্কতা : গনিয়া মাছ প্রকৃতিতে ৩ বছর বয়সে পরিপক্কতা অর্জন করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এটি প্রথম বছরেই পরিপক্কতা অর্জন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মিঠাপানির বিভিন্ন জলাশয়ে পুরুষ মাছ প্রথম পরিপক্কতার সময় ১৪-২৩ সেমি. এবং স্ত্রী মাছ ১৮-৩০ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়। বয়স ও আকারের দিক থেকে পুরুষ মাছটি স্ত্রী মাছের তুলনায় আগে পরিপক্ক হয়। সর্বাধিক প্রজনন ঋতু মে -জুন মাসে মাছটির ওজন প্রায় ৩০০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। মাছটি ১ বছর বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি বয়সে পরিপক্কতা লাভ করে থাকে। তবে ২ বছর বয়সের পরিপক্ক মাছ কৃত্রিমভাবে প্রজননের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
ডিমের সংখ্যা : রুইজাতীয় মাছের মতোই এর ডিমের সংখ্যা অনেক বেশি। একটি পরিপক্ক ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের গনিয়া মাছ হতে ২,৪৫,০০০ টি এবং ১.৫- ১.৬ কেজি ওজনের মাছ হতে ৫,৪০,০০০ টি ডিম পাওয়া যায়। এ মাছের ডিমগুলো ভাসমান, স্বচ্ছ, গোলাকার এবং আঠলো নয়।
মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা :
প্রজননক্ষম মাছ শনাক্তকরণ : প্রজনন ঋতুতে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখেই পুরুষ ও স্ত্রী ব্রুড মাছ সহজেই শনাক্ত করা যায়। স্ত্রী মাছের পেটে ডিম ভর্তি থাকার জন্য তলপেট নরম, ফোলা আর বড় দেখায় এবং পেক্টোরাল পাখনা মসৃণ হয়ে থাকে। আর দেহের রং হয় লালচে। অপরদিকে, পুরুষমাছের ক্ষেত্রে তলপেটে আলতোভাবে চাপ দিলেই মিল্ট বের হয়ে আসে এবং পোক্টোরাল পাখনা অমসৃণ হয়ে থাকে।
কৃত্রিম প্রজনন কৌশল : পিজি নির্যাস কিংবা সিনথেটিক হরমোন দিয়েও গনিয়া মাছের কৃত্রিম প্রজনন সফলভাবে করা যায়। তবে তুলনামূলকভাবে সিনথেটিক হরমোন যেমন ওভাপ্রিম দিয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য জাল টেনে মাছ ধরে পরিপক্ক পুরুষ ও স্ত্রী মাছ বাছাই করা হয়। বাছাইয়ের পর মাছগুলোকে হ্যাচারির ট্যাংকে ৬-৮ ঘন্টা রেখে খাপ খাওয়ানো হয়। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ব্রুড মাছকে সাধারণত একবারই ইনজেকশন দেওয়া হয়। সিনথেটিক/ হরমোন যেমন- ওভাপ্রিম ১ম ডোজ ০.৫ মিলি/কেজি স্ত্রী ও ০.২ মিলি/কেজি পুরুষ মাছকে ইনজেকশন দেয়া হয়। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় মাছের ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠ পাখনার নিচের দিকে মাংসে ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। ইনজেকশন দেয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে (২ঃ১) অনুপাতে প্রজনন হাপায় ছেড়ে দেয়া হয়। হাপাতে মাছ দেয়ার পর কৃত্রিম ঝর্ণা সৃষ্টির জন্য পিভিসি পাইপ ছিদ্র করে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। ইনজেকশন দেয়ার প্রায় ৮-১০ ঘন্টার মধ্যেই প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে মাছ ডিম দেয়। ডিম ছাড়ার পর পরই ব্রুড মাছগুলোকে প্রজনন হাপা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। পানির তাপমাত্রা ভেদে সাধারণত গনিয়া মাছ ডিম দেয়ার ১৮-২৪ ঘন্টার মধ্যেই ডিম ফুটে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম থেকে রেণু পোনা বের হওয়ার পর হাপাতে ২-৩ দিন রাখতে হয় এবং রেণুর কুসুমথলি নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথেই রেণুগুলোকে ২ দিন সিদ্ধ ডিমের কুসুম দিনে ৪ বার খাবার হিসেবে দিতে হবে। নিন্মের সারণি- ১ এ গনিয়া মাছের ব্যবহৃত হরমোনের মাত্রা এবং প্রজননের তথ্য উল্লেখ করা হলো :
গনিয়া মাছের প্রজননে ব্যবহৃত হরমোন ও পরিমাণ :
মাছের লিঙ্গ |
হরমোনের নাম |
১ম ডোজ (মিলি/কেজি) |
লেটেন্সি পিরিয়ড (ঘন্টা) |
ডিম নিষিক্তকরণ হার |
হ্যাচিং পিরিয়ড (ঘন্টা) |
ডিম ফুটার হার |
স্ত্রী পুরুষ |
ওভাপ্রিম ওভাপ্রিম |
০.৫ ০.২ |
৮-১০ |
৮০-৯০% |
১৮-২৪ |
৮০-৮৫% |
গনিয়া মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা
গনিয়া মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা মূলত রুই জাতীয় মাছের পোনা উৎপাদনের মতোই। যেহেতু নার্সারি ব্যবস্থাপনার ওপরই নার্সারি পুকুরে পোনার বাঁচার হার নির্ভর করে সে কারণে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত থেকে শুরু করে পোনা আহরণ পযর্ন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই খুব সতর্ক থাকতে হয়। গনিয়া মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনায় নিন্মোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয় :
রেণু মজুদের পর নিন্মের সারণী অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে :
গনিয়া মাছের নার্সারি পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের তালিকা
সময় |
রেণুর ওজন |
খাদ্য |
প্রয়োগের নিয়ম |
১-৪ দিন |
১০০ গ্রাম |
১০০ গ্রাম ময়দা ও ডিমের কুসুম একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। |
৩ বার |
৫-৮ দিন |
১০০ গ্রাম |
৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ১০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে। |
সকাল ও বিকাল |
৯-১৫ দিন |
১০০ গ্রাম |
৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ২০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে। |
সকাল ও বিকাল |
১৬-২২ দিন |
১০০ গ্রাম |
৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ৪০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে। |
সকাল ও বিকাল |
২৩-৩০ দিন |
১০০ গ্রাম |
৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ৫০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে। |
সকাল ও বিকাল |
এভাবে নার্সারি পুকুরে রেণু প্রতিপালন করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ১.৫-২.০ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা যায়।
গনিয়া মাছের চাষ
গনিয়া মাছ রুই জাতীয় মাছের সাথেই মিশ্রচাষ করা যায়। আবার মৌসুমী পুকুরেও চাষ করা যায়। মাছটি পুকুরের তলদেশের মাছ বিধায় মৃগেল এর পরিবর্তে গনিয়া মাছ দিয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় কার্পেও মিশ্র চাষ করা সম্ভব এবং বছরে ২ টি ফসলও পাওয়া যেতে পারে। মাছটির বাজার জাত ওজন ১০০-৩০০ গ্রাম।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি : মিশ্রচাষের জন্য ৩০-৫০ শতাংশ আয়তনের পুকুর হলে ভালো যেখানে কমপক্ষে ৮-১০ মাস প্রায় ৪-৫ ফুট পানি থাকে। প্রথমেই পুকুরের পাড় ও তলদেশে ভালো করে মেরামত করে নিতে হবে। পাড়ে অথবা পানিতে আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করে নিতে হবে। রাক্ষুসে মাছ দূর করার জন্য বার বার জাল টানতে হবে। তারপর শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর শতাংশে ৮-১০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য গোবর প্রয়োগের ৪ -৫ দিন পর শতাংশে ১০০ - ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
পোনা মজুদ ও চাষ ব্যবস্থাপনা : পুকুর প্রস্তুতির পর রুইজাতীয় মাছের সাথে বিভিন্ন পদ্ধতিতে গনিয়া মাছ চাষ করা যেতে পারে। রুইজাতীয় মাছের সাথে শতাংশ প্রতি ১২০ -১৫০ ( রুই : কাতলা : গনিয়া, ১:১:১ ) টি মজুদ করা হয়। পোনার আকার ৩ -৪ ইঞ্চি হলে ভালো। পোনা মজুদের পরের দিন থেকেই মাছের দেহ ওজনের ৩- ৬% হারে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার পুকুরে ২ বার প্রয়োগ করতে হবে। মিশ্র চাষের পুকুরে পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর অন্তর পুকুরে শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরে সবসময় পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে ও পুকুরে কোনো প্রকার আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না। মাছকে রোগমুক্ত রাখতে পুকুরে শীতের শুরুতে শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। ৬-৮ মাস পরেই মাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী মাছ আহরণ করা যেতে পারে। এর বৃদ্ধি মৃগেল মাছ কিংবা অন্যান্য তলদেশীয় মাছের মতোই। বছরে মাছটির ওজন প্রায় ৬০০ - ৭৫০ গ্রাম হয়, তবে ৩০০ -৪০০ গ্রাম হলেই বাজারজাত করা যায়।