ভূমিকা
মাছ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অন্যতম অনুসঙ্গ। বাংলাদেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৬০% আসে মাছ থেকে। আমাদের আমিষের ঘাটতি মাছ চাষের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। বর্তমানে মাছ চাষ অত্যন্ত লাভজনক। মাছ চাষের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব।
কার্পের মিশ্রচাষ
পুকুর নির্বাচন
পুকুরের আয়তন ৩০ শতাংশ থেকে বড় যে কোন আকারের হতে পারে, গভীরতা ৪-৮ ফুট, মাটি দো-আঁশ অথবা এটেল দো-আঁশ এবং পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উত্তম।
পুকুর প্রস্তুতকরণ
রোটেনন প্রয়োগ মাত্রা ও পদ্ধতি
৩০ গ্রাম/শতাংশ/ফুট পানি হিসেবে রোটেনন প্রয়োগ করে এই রাক্ষুসে ও অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ দূর করা যায়। যদি পুকুরের আয়তন ১০০ শতক এবং গভীরতা ৭ ফুট হয় তবে ৩০/১০০/৭+২১০০গ্রাম বা ২কেজি ১০০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োজন হবে। পরিমাণ মত পানি নিয়ে তাতে রোটেনন পাউডার মিশিয়ে কাঁই তৈরি করতে হবে। তারপর ১/৩ অংশ আলাদা করে তা দিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে। বাকি অংশ বেশি পানিতে গুলিয়ে পাতলা করতে হবে। এর পর কড়া রোদের সময় পাতলা অংশ সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে ও বলগুলি সমভাবে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। রাক্ষুসে এবং অনাকাঙিক্ষত প্রজাতির মাছ দূর করার পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ৭ দিন পর শতাংশ প্রতি নিম্নহারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম |
মাত্রা/শতাংশ |
ইউরিয়া |
১০০-১৫০ গ্রাম |
টিএসপি |
১০০-১৫০ গ্রাম |
সরিষার খৈল |
৫০০ গ্রাম |
পোনা মজুদঃ কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষে ভাল উৎপাদন পাওয়ার জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা উচিত।
মিশ্রচাষের জন্য নির্বাচিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা মজুদের হার
মডেল-১ (শতকে ৩০-৩৫টি, কেজিতে ২৫-৩০টি পোনা) |
|
মাছের প্রজাতি |
সংখ্যা/শতাংশ |
সিলভার কার্প |
৭-৮ |
কাতলা |
৪-৫ |
রুই |
৬-৭ |
মৃগেল |
৭-৮ |
কমন কার্প/মিরর কার্প |
৪-৫ |
গ্রাস কার্প |
২ |
মোট |
৩০-৩৫ |
মডেল-১ এর চাষকাল ৮ মাস এবং পোনার আকার ৪-৬ ইঞ্চি। এই মডেলে ৩ মাস পরপর বিক্রয়যোগ্য মাছ আহরণ করে সমসংখ্যক সমপ্রজাতির পোনা পুনরায় মজুদ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে চাপের পোনা উত্তম।
মডেল-২ (শতকে ১০-১৫টি, কেজিতে ৪-৫টি পোনা |
|
মাছের প্রজাতি |
সংখ্যা/বিঘা |
সিলভার ও বিগহেড কার্প |
৫০-৬০ |
কাতলা |
২৫-৩০ |
রুই |
১২০-১৪০ |
মৃগেল |
১০০-১২০ |
কমন কার্প/মিরর কার্প |
৪০-৫০ |
গ্রাস কার্প |
০২-০৩ |
মোট |
৩৩৭-৪০৩ |
মডেল-২ এর চাষকাল ৮-৯ মাস। এই পদ্ধতিতে বিগত বছরের পুরাতন পোনা বা চাপের পোনা ব্যবহার করা হয় এবং সিলভার কার্প ৩-৪ মাস পর বাজারজাত ও আবার মজুদ করা হয়।
মডেল-৩ |
||
মাছের প্রজাতি |
সংখ্যা/বিঘা |
ওজন প্রতি কেজি/প্রতিটি |
সিলভার কার্প |
৫০-৬০ |
প্রতিটির ওজন ০.৪০-০.৫০ কেজি |
কাতলা |
১৫-২০ |
প্রতিটির ওজন ১.০০-১.৫০ কেজি |
রুই |
৮০-১০০ |
প্রতিটির ওজন ০.৬০-০.৭৫ কেজি |
মৃগেল |
৩০-৪০ |
প্রতিটির ওজন ০.৫০-০.৬০ কেজি |
কমন কার্প/মিরর কার্প |
০৪-০৫ |
প্রতিটির ওজন ০.৫০-০.৬০ কেজি |
গ্রাস কার্প |
০২-০৩ |
প্রতিটির ওজন ০.২০-০.২৫ কেজি |
মোট |
১৮১-২২৮ |
|
*১ বিঘা= ৩৩ শতাংশ
মডেল-৩ এর চাষকাল ৬-৭ মাস। এই পদ্ধতিতে বিগত বছরের পুরাতন পোনা বা চাপের পোনা ব্যবহার করা হয় এবং সিলভার কার্প ৩-৪ মাস পর বাজারজাত ও আবার মজুদ করা হয়।
সার ও খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তথা মাছের ভাল বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এই প্রয়োগ দৈনিক বা সাপ্তাহিক মাত্রায় হতে পারে।
সার |
পরিমাণ/শতাংশ/সপ্তাহ |
ইউরিয়া |
১০০ গ্রাম |
টিএসপি |
১০০ গ্রাম |
পুকুরের পানি যদি অত্যধিক সবুজ রং ধারণ করে তা হলে সার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ
উপাদান |
শতাংশ |
চালের গুড়া/গমের ভুসি/অটো কুড়া/ভুট্টা চূর্ণ |
৫৭% |
খৈল |
৩০% |
ফিসমিল |
১০% |
আটা |
৩% |
ভিটামিন প্রিমিক্স |
১০০ গ্রাম |
মোট |
১০০% |
সাধারণ রোগ বালাই
রোগের নাম |
লক্ষণ |
প্রতিকার |
ক্ষত রোগ |
লাল দাগ দেখা যায় ও আঁইশ পড়ে যায় |
প্রতি শতাংশ প্রতি ১/২ কেজি হারে চুন ও ১/২ কেজি হারে লবণ প্রয়োগ |
মাছের লেজ ও পাখনা পচা রোগ |
লেজ ও পাখনা পচে যায়, পাখনা ছিড়ে সাদা হয়ে যায় |
প্রতি শতাংশ প্রতি ফুট গভীরতায় ২৪-৩৬ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতায় ৬ গ্রাম হারে তুতে প্রয়োগ |
ফুলকা পচা রোগ |
ফুলকা ফুলে যায় ও রক্ত জমাট বাধে |
চুন ১/২ কেজি প্রতি শতাংশ হারে প্রয়োগ |
মাছের উকুন |
মাছ শক্ত কিছুতে গা ঘষে |
প্রতি শতাংশ প্রতি ফুট গভীরতায় ০২-০৩ মিলি হারে সুমিথিয়ন/ফেনিট্রন প্রয়োগ (৭ দিন পরপর ৩ বার) |
সাধারণ সমস্যাবলী
সমস্যা |
লক্ষণ |
সমাধান |
অক্সিজেন স্বল্পতা |
মাছ পানির উপরিভাগে ভেসে উঠবে, হা করে খাবি খায় |
পানিতে লাঠি পেটা করে বা সাঁতার কেটে ঢেউ সৃষ্টি করতে হবে, প্রতি শতাংশে ৫-৭ গ্রাম অক্সিফ্লো/অক্সিএক্স/অক্সিলাইফ প্রয়োগ, সম্ভব হলে বাইরে থেকে পরিস্কার পানি পুকুরে ঢুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। |
পানির উপরে সবুজ স্তর |
অতিরিক্ত শ্যাওলার উপস্থিতি |
সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে, শতাংশে ১/২ কেজি হারে চুন অথবা শতাংশে ১০-১২ গ্রাম তুঁতে ছোট ছোট পোটলায় বেধে পানির উপর থেকে ১০-১৫ সে.মি. নিচে বাঁশের খুটিতে বেধে প্রয়োগ করা যেতে পারে। |
পানির উপরে লাল স্তর |
অতিরিক্ত লৌহের উপস্থিতি |
ধানের খড় বা কলাপাতা পেচিয়ে দড়ি তৈরি করে লাল স্তর উঠানো, অথবা প্রতি শতাংশে ১০০-১২৫গ্রাম ইউরিয়া ২-৩ বার (১০-১২ দিন পরপর) প্রয়োগ করা যেতে পারে। |
মনে রাখতে হবে:
১. পুকুরে অতিরিক্ত খাদ্য দেওয়া যাবে না।
২. মেঘলা দিন ও বৃষ্টির সময় খাদ্য না দেওয়া ভাল।
৩. প্রতি সপ্তাহে হররা টেনে দিতে হবে।
৪. প্রতি মাসে একবার প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে।
৫. পুকুর সর্বদা আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
৬. প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
৭. পানিতে বুদবুদ দেখা দিলে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
৮. পানির স্বচ্ছতা ৮ সেন্টিমিটারের নীচে নেমে গেলে সার ও খাবার দেয়া বন্ধ করতে হবে।
৯. পোনা ছাড়ার পর প্রতিদিন সকালে ও বিকালে পোনার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে হবে।