গরুর টিকা , গরুর রোগ ও তার প্রতিকার ব্যবস্থা ,

ক্ষুরা রোগ (Foot and Mouth Diseases) ও এর প্রতিকার

MD.AL.MAMUN | ১৫ মে ২০২৪

ক্ষুরা রোগ থেকে গবাদিপশুকে বাঁচান

ক্ষুরা রোগ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ যার ফলে মুখে ও পায়ে এক সাথে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে অনেক গবাদিপশু ক্ষুরা রোগে প্রতি বছর আক্রান্ত হয়। এলাকাভেদে রোগের প্রচলিত নাম বাতা, জ্বরা,ক্ষুরাপাকা, এঁসো,খুরুয়া,তাপরোগ,খুরাচল ইত্যাদি। দুই ক্ষুরওয়লা সকল পশুই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণতঃ গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়। ও শুকর এ রোগের শিকার । আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শের মাধ্যমে সুস্থ পশুর দেহে এ রোগ সংক্রমিত হয় এবং বাতাসের সাহায্যে এ রোগের ভাইরাস দুরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই দেশে তিন ধরণের ভাইরাস স্ট্রেইন (A,O& Asia-1) দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয। এ রোগে বাছুরের মৃত্যুর হার ব্যাপক এবং বয়স্ক পশুর উপর এর প্রভাব মারাত্মক । সময়মতো প্রতিষেধক টিকা দিলে গবাদিপশুকে সহজেই এ রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

এ রোগের লক্ষণ:

  • প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৭ সেলসিয়াস ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এই জ্বর ২/৩ দিন থাকতে পারে।
  •     অতঃপর জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভিতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝখানে ফোস্কা উঠে,পরে ফোস্কা ফেটে লাল ঘায়ের সৃষ্টি হয়।
  • প্রদাহের ফলে মুখ দিয়ে বিরামহীন লালা ঝরতে থাকে, ঠোট নাড়া চাড়ার ফলে সাদা সাদা ফেনা বের হতে থাকে এবং চপ চপ শব্দ হয়।
  • ক্ষুরের ফোস্কা ফেটে ঘা হয়, পা ফুলে ব্যাথা হয়। ঘা বেশী হওয়ায় চলাফেরা করতে কষ্ট হয় অর্থাৎ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে।
  • মাছি ঘায়ে ডিম পাড়ে। মাছির লার্ভা ও জীবাণুতে ঘা বিষিয়ে উঠে বা জটিলতা সৃষ্টি করে ফলে পশু পা ছুড়তে থাকে যেন পায়ে কিছু লেগে আছে।
  • গাভীর ওলানে ফোস্কা হতে পারে, ফলে ওলান ফুলে উঠে এবং দুধ কমে যায়।
  • এ রোগে বাছুর মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। ছোট বাছুরের হৃদপিন্ড (হার্ট) আক্রান্ত হয়ে কোন লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ মারা যেতে পারে।

এ রোগে আক্রান্ত হলে করণীয়:

  • ক্ষুরা রোগ হওয়ার সাথে সাথে আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে পরিষ্কার শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই কাঁদা বা পানিতে রাখা যাবে না ।
  • এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। তাই আক্রান্ত পশুকে অন্যত্র নেয়া , হাটে ক্রয় বিক্রয় করা এবং বাইরের কোন পশুকেও এ এলাকায় আনা উচিৎ নয়।
  • আক্রান্ত এলাকায় এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় সকল সুস্থ পশুকে অবিলম্বে টিকা দিতে হবে।
  • আক্রান্ত পশুকে কচি ঘাস ও তরল খাবার যেমন-কুঁড়া ও ভূষির সাথে ভাতের ফেন বা জাউ ভাত খেতে দিতে হবে।
  • বাছুরকে আক্রান্ত গাভীর ওলান থেকে দুধ খাওয়ানো যাবে না । তবে দুধ দোহানোর পর সিদ্ধ করে খাওয়ানো যাবে।
  • যিনি আক্রান্ত পশুর সেবা যত্ন করবেন তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড়,হাত পা এবং ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস অবশ্যই জীবাণুনাশক ঔষধ দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। (এজন্য ১ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ আইওসান/আয়োডিন দ্রবণ মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে) ।
  • আক্রান্ত পশুর মুখ ও পায়ের ঘা পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট মেশানো পানি (হালকা বেগুনী রং এর) বা খাওয়ার সোডা মেশানো পানি দিয়ে দিনে প্রতিদিন ৩-৪ বার ধুয়ে দিতে হবে।
  • ঔষধ মেশানো পানি দিয়ে ধোঁয়ার পরে পায়ের ক্ষতস্থানে সালফা নিলামাইড বা এ ধরণের পাউডার এবং মুখ ও জিহ্বার ক্ষত স্থানে সোহাগার খৈ গুরা মধু বা ঝোলাগুড়ের সাথে মিশিয়ে লাগানো যেতে পারে।
  • পায়ের ঘায়ে যাতে মাছি না বসে সেজন্য ৪ ভাগ নারকেল তেলের সাথে ১ ভাগ তার্পিন তেল মিশিয়ে ক্ষত স্থানে লাগাতে হবে।
  • রোগ হওয়ার সাথে সাথে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য জরুরী ভিত্তিতে নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ/ মেট্টোপলিটন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।

এ রোগ বিস্তারের বাহক:

ক্ষুরারোগ হওয়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই । বছরের যে কোন সময় এ রোগ হতে পারে । এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত পশুর ফোস্কা ফেটে অন্য পশুর দেহে বিস্তার লাভ করে । পায়খানা, প্রস্রাব, দুধ, শ্লেস্মা, লালা ইত্যাদি ছাড়াও রোগাক্রান্ত পশুর খাদ্যদ্রব্য এবং তার সংষ্পর্শে আসা যন্ত্রপাতি , আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়,খড় ইত্যাদিও এ রোগের বাহক । তবে বাতাসের সাহায্যে এ রোগের ভাইরাস অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

এ রোগ হলে:

  • দুধ ও মাংসের উৎপাদন হ্রাস পায়।
  • চাষাবাদ দারুণভাবে ব্যাহত হয় ফলে কৃষিজাত ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়।
  • গ্রামাঞ্চলে মালামাল পরিবহণে এবং শস্য মাড়াইয়ে অসুবিধা হয় (ফলে ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়)।
  • ছোট বাছুরের ব্যাপক মৃত্যুর ফলে গো-সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়।
  • গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হয় এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। এ সাথে ওলানের প্রদাহ হলে গাভীর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা চিরতরে লোপ পেতে পারে।
  • জীবাণুমুক্তকরণ অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
  • আক্রান্ত পশু সুস্থ হয়ে উঠলেও পূর্বের মতো কর্মক্ষম/উৎপাদনক্ষম হতে পারে না।

এ রোগ প্রতিরোধ:

ক্ষুরারোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই কার্যকর তাই ক্ষুরারোগ প্রতিরোধের জন্য গবাদিপশুকে প্রতি ৬ মাস অন্তর এ রোগের টিকা দিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশে ক্ষুরারোগের প্রতিষেধক টিকায় মোট ৩টি ভাইরাস স্ট্রেইন (A,O& Asia-1) ব্যবহার করা হয়।

টিকা প্রদান কর্মসূচি:

টিকার নাম

প্রাণির প্রজাতি ও টিকা প্রয়োগের বয়স

টিকার মাত্রা

প্রয়োগ পথ

টিকার কার্যকাল

টিকা সংরক্ষণ

প্রাপ্তি স্থান

ট্রাইভ্যালেন্ট এফ.এম.ডি

গরু/মহিষ-৬মাস

ছাগল/ভেড়া-৩ মাস

গরু/মহিষ-৬ এম এল

ছাগল/ভেড়া-৩ এম এল

গলকম্বলের চামড়ার নীচে

৬ মাস

৪ ডিগ্রি থেকে ৮ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬ মাস

উপজেলা/মেট্রোপলিটন প্রাণিসম্পদ অফিস