বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ , মৎস্য খাতের প্রযুক্তি ,

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

ABUL KASHEM | ০৯ মে ২০২৪

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

 মাছ চাষ করার জন্য এখন আর  পুকুর বা কোন জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না । আধুনিক যুগে জমির স্বল্পতার জন্য মাছ চাষ এখন হচ্ছে ঘর বা কোন আবদ্ধ জায়গায়। নির্দিষ্ট কলাকৌশল আর প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ঘরের ভিতর চৌবাচ্চাতে চাষ করা যাচ্ছে মাছ।

এ পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে বায়োফ্লক। একোয়াকালচার পদ্ধতির উন্নত সংস্করণ হচ্ছে মাছ চাষের নতুন এ প্রযুক্তি। বায়োফ্লক টেকনোলজি ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। বায়োফ্লক প্রযুক্তির জনক ইজরায়েলি বিজ্ঞানী ইয়ান এভনিমেলেচ।

বায়োফ্লক কি:

বায়ো শব্দটি গ্রীক বায়োস থেকে এসেছে, যার অর্থ জীবন। আর ফ্লক মানে আলতোভাবে লেগে থাকা কনার সমষ্টি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুন:ব্যবহার যোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চৌবাচ্চার পানিতে ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমন্বয়ে পাতলা একটি আস্তরণ তৈরি হয় যা পানিকে ফিল্টার করে। পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয় এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ ‍করতে পারে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অনুজীব মূলত দুটি প্রধান ভূমিকার পালন করে:

১. অনুজীব পানিতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগ গুলোকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে।

২. এ প্রযুক্তি খাদ্য রূপান্তর হার এবং মাছ চাষে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে চাষের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।

এ প্রযুক্তিতে পানিতে বিদ্যমান কার্বোহাইড্রেট বা কার্বন ও অ্যামোনিয়া বা নাইট্রোজেনের অনুপাত নিয়ন্ত্রিত থাকে। বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে খামারে রোগবালাইও কম হয়। বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়ার (উপকারী ব্যাকটেরিয়া) দ্রুত বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়, এ ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অনুজীব অ্যামোনিকে প্রোটিনে রূপান্তর করে । তবে এর জন্য পানিতে প্রচুর এয়ারেশন অর্থাৎ বাতাস মিশ্রিত করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ পানিতে প্রচুর মাছ থাকার কারণে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। তাছাড়া অক্সিজেনের ঘাটতি পড়লে অ্যামোনিয়া থেকে প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ করে ব্যাকটেরিয়াগুলো উল্টো অ্যামোনিয়া উৎপাদন শুরু করে দেবে। একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প প্রযুক্তি যা ক্রমাগতভাবে  পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুনঃআবর্তনের মাধ্যমে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করে । পানি পরিবর্তন করতে হয় না  বলে এটিতে পানির খরচও হয় খুব কম । এটি একটি পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি । বায়োফ্লক প্রযুক্তিটি থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মায়ানমার ও ভারতে স্বল্প পরিসরে সফলভাবে ব্যবহার করা হলেও এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা । এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে । আরো বড় পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে যে সমস্ত মাছ চাষ করা যায়:

বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর যেসব মাছ চাষ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলাপিয়া, রুই, শিং,মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । তবে, যারা বায়োফ্লক প্রযুক্তিটি প্রথমবারের মত ব্যবহার করতে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করবেন ।তবে অন্যান্য দেশে তেলাপিয়া ও চিংড়িই মূলত বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় চিংড়ি চাষ।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সুবিধা:

উচ্চ বায়োসিকিউরিটি এই প্রযুক্তিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক) মূল ভূমিকা পালন করে। বায়োফ্লক প্রযুক্তির সিস্টেমে প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে , ফলে ক্ষতিকর রোগ জীবাণু সহজে জন্মাতে পারে না । এতে বায়োসিকিউরিটি বা জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

অ্যামোনিয়া দূরীকরণ:

সিস্টেমে বিদ্যমান উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছ চাষের প্রধান নিয়ামক অ্যামোনিয়াকে মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান প্রোটিনে রূপান্তর করে। ফলে সিস্টেমে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

মাছের বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ:

ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ, মাছের মল ও উচ্ছিষ্ট খাদ্যকে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনে রূপান্তরের মাধ্যমে মাছের বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করে।

উত্তম প্রোটিনের উৎস:

উপকারী ব্যাকটেনিয়া (প্রোবায়োটিক) এই সিস্টেমে বিদ্যমান ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া ও বাইরে থেকে সরবরাহকৃত কার্বোহাইড্রেটকে ব্যবহার করে অণুজীব আমিষ তৈরি করে। তাছাড়া ডায়াটম প্রোটোজোয়া, অ্যালগি, ফেকাল পিলেট, জীবদেহের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া ম্যাক্রো-এগ্রিগেট তৈরি করে যা মাছের উত্তম প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য, মল-মূত্র থেকে নিঃসৃত অ্যামোনিয়াকে ব্যবহার করে অণুজীবন প্রোটিনে রূপান্তর করে। এর ফলে বাড়তি খাবার খরচ কমে, পাশাপাশি খাদ্য অপচয় রোধ হয়। যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ চাষে ৬০ ভাগ খরচই হয় খাবারের পেছনে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে কার্বোহাউড্রেট ও প্রোবায়োটিক সরবরাহই যথেষ্ট। প্রোটিন তৈরির কাজটি করে দেয় সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া। ফলে অন্যান্য সিস্টেমের চেয়ে খাদ্য কম লাগে, বেশি লাভ করা যায়।

বায়োফ্লক প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক:

সহজ চাষ পদ্ধতি:

এটি একটি সহজ চাষ পদ্ধতি। সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারিগরি দক্ষতা অর্জন করলে বাড়িতেই ট্যাংকে সহজে মাছ চাষ করা যায়।

 খুব কম পানি পরিবর্তন:

মাছ চাষের অন্যতম নিয়ামক অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপকারী ব্যাকটেরিয়া পানির গুণাগুণ রক্ষা করে ফলে ট্যাংকের পানি খুব কম (মোট পানির খুবই সামান্য অংশ) পরিবর্তন করলেই চলে। এমনকি সব কিছুর সঠিক মাত্রা ধরে রাখতে পারলে একবারও পানি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না।

জমি এবং পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ:

এই সিস্টেমে ছোট ছোট ট্যাংকে অনেক মাছ উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া ট্যাংকের পানি খুব কম বা একেবারেই না পরিবর্তন করলেও চলে, তাই অল্প জমি ও অল্প পানি ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। যা জমি ও পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।

পরিবেশবান্ধব অ্যাকোয়াকালচার সিস্টেম:

প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারী ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে পানির ব্যবহার খুব কম। তাই এটি একটি পরিবেশবান্ধব মাছ চাষ পদ্ধতি।

রোগের প্রাদুর্ভাব দূরীকরণ:

বায়োফ্লক সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধা প্রদান করে ফলে ঐসব ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ থেকে মাছ রক্ষা পাবে। যার ফলে মাছ চাষের সময় খামারকে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করা সম্ভবপর হয়।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের অসুবিধাসমূহ:

১. মিশ্রণ এবং বায়ুচালনের জন্য শক্তির প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়।

২. এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, পানি শ্বসনের হারের সাথে সাথে প্রতিক্রিয়ার সময় হ্রাস পায়।

৩. শুরুর সময়কালীন প্রচুর সময় লাগে।

৪. ক্ষারীয় পরিপূরক প্রয়োজন।

৫.বায়োফ্লক পদ্ধতি নাইট্রেট জমে থেকে দূষণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

৬. সূর্যের আলো উদ্ভাসিত সিস্টেমগুলির জন্য এটি ক্ষতিকারক হতে পারে।

পদ্ধতিটি কিছুটা কৃত্রিম হওয়ার জন্য এর প্রচুর যত্ন নেওয়া এবং পরিচালনা প্রয়োজন। যা ফ্রেশ ওয়াটার পদ্ধতিতে হয় না।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য যা লাগবে:

চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, লোহার খাঁচা, ত্রিপল, আউটলেট, টিভিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়াম টেস্ট কিড, অক্সিজেনের জন্য মটর, বিদ্যুৎ, মাছের পোনা, খাদ্য ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে পানি ব্যবস্থাপনা ও ফ্লক তৈরীর কলাকৌশল:

প্রথমে ট্যাংক ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এর পর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। পানিতে আয়রণের মাত্রা ০.২ ppm এর বেশি হলে পানি থেকে আয়রণ দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। আয়রন দূর করার জন্য প্রতি টন পানিতে ২৫-৩০ ppm হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের পর ১০-১২ ঘন্টা একটানা বাতাস সরবরাহ করতে হবে। এর পর ৫০ ppm হারে ফিটকিরি প্রয়োগ করে আরও ১২ ঘন্টা পানিতে অনবরত বাতাস সরবরাহ করতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পানিতে ১০০ ppm হারে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3) চুন প্রয়োগ করে বাতাস সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে। এর পর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এ সময় পানির যে গুনাবলীর দিকে নজর রাখতে হবে তা নিচে দেয়া হলো:

১. তাপমাত্রা থাকতে হবে ২৫-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে;

২. পানির রং-সবুজ, হালকা সবুজ, বাদামী হলে চলবে;

৩. দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৭-৮ মিলিগ্রাম থাকতে হবে;

৪. পিএইচ হতে হবে ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে;

৫. ক্ষারত্ব থাকতে হবে প্রতি লিটারে ৫০-১২০ মিলিগ্রাম;

৬. অ্যামোনিয়া প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম;

৭. ক্যালসিয়াম প্রতি লিটারে ৪-১৬০ মিলিগ্রাম;

৮. অ্যামেনিয়া প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম;

৯. নাইট্রাইট প্রতি লিটারে ০১-০.২ মিলিগ্রাম;

১০.নাইট্রেট প্রতি লিটারে ০-৩ মিলিগ্রাম

১১. ফসফরাস প্রতি লিটারে ০.১-৩ মিলিগ্রাম

১২. হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম;

১৩. আয়রন প্রতি লিটারে ০.১-০.২ মিলিগ্রাম

১৪. পানির স্বচ্ছতা ২৫-৩৫ সে.মি.;

১৫. পানির গভীরতা ৩ থেকে ৪ ফুট

১৬. ফ্লকের ঘনত্ব ৩০০গ্রাম/টন

১৭. TDS প্রতি লিটারে ১৪০০০-১৮০০০ মিলিগ্রাম

১৮. লবণাক্ততা ৩-৫ পিপিটি(ppt);

 

পানিতে যেভাবে ফ্লক তৈরি করা হয়:

চাষ ট্যাংকের ১২ ভাগের ১ ভাগ পানি নিয়ে পানিতে ১০০০ ppm হারে আয়োডিন ছাড়া লবণ প্রয়োগ করতে হবে। লবণ প্রয়োগের পর TDS পরীক্ষা করে নিতে হবে। বায়োফ্লকের জন্য ১৪০০-১৮০০ ppm, TDS থাকা ভাল। যদি লবণ প্রয়োগ করে আদর্শ মাত্রায় TDS রাখতে হবে। এর পর প্রথম ডোজে ৫ ppm প্রোবায়োটিক, ৫০ ppm ইস্ট, পানি প্রতি টনের জন্য ১ লিটার, একটি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮-১০ ঘন্টা কালচার করে প্রয়োগ করতে হবে। ২য় দিন থেকে ১ ppm প্রোবায়োটিক, ৫ ppm চিটাগুড়, ১ ppm ইস্ট, প্রতি টনের জন্য ১ লিটার পানি দিয়ে কালচার করে প্রতি দিন প্রয়োগ করতে হবে

 ppm for “parts per million” and it also can be expressed as milligrams per liter(mg/L)

বায়োফ্লক পর্যবেক্ষণ:

  • পানিতে যথাযথ পরিমাণ ফ্লক তৈরি হলো কিনা সেটা বুঝতে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে:
  • পানির রং সবুজ বা বাদামী দেখায়:
  • পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখা যায়;
  • পানির অ্যামোনিয়া পরীক্ষা করলে পানি অ্যামোনিয়া মুক্ত পাওয়া যাবে;
  • ক্ষুদেপোনা দেওয়ার পর তাদের বংশবিস্তার পরিলক্ষিত হয়।

ট্যাংক তৈরি:

প্রথমে গ্রেড রড দিয়ে ট্যাংকের বৃত্তাকার খাঁচাটি তৈরি করতে হবে। যেই স্থানে ট্যাংকটি স্থাপন করা হবে সেই জায়গাতে খাঁচার পরিধির সমান করে সিসি ঢালাই দিতে হবে। বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে পানির একটি আউটলেট পাইপ স্থাপন করতে হবে।

এরপর খাঁচাটিকে ঢালাই মেঝের উপর স্থাপন করে মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। মেঝের মাটি শক্ত ও সমান হলে ঢালাইয়ের পরিবর্তে পরিধির সমান করে পুরু পলিথিন বিছিয়েও মেঝে প্রস্তুত করা যায়। এরপর উন্নতমানের তারপুলিন দিয়ে সম্পূর্ণ খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। তার উপর পুরু পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদিত করে তাতে পানি মজুদ করতে হবে।

এরেটর পাম্প:

বায়োফ্লক ট্যাংকে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়ার জন্য একটি এরেটর পাম্প স্থাপন করতে হবে। ছয় ফুট ব্যাসার্ধের এবং চার ফুট উচ্চতার একটি ট্যাংকে প্রায় ত্রিশ হাজার শিং মাছ চাষ করা যাবে, যদি সেখানে যথেষ্ট এরেশনের ব্যবস্থা থাকে।

বায়োফ্লকের প্রয়োগ:

এক হাজার বর্গমিটার একটি জলাশয়ে আড়াই কেজি বাদাম খৈল, তিন কেজি চালের গুঁড়া, পাঁচশো গ্রাম ইস্ট পাউডার, তিন কেজি চিটাগুড়, দেড় কেজি আটা, তিনশ গ্রাম কলার সঙ্গে যে কোনোও পোনা মাছের খাবার দুই কেজি মিশিয়ে ৪৮-৬০ ঘন্টা  একটি ঢাকনাযুক্ত পাত্রে প্রায় তিন গুণ পানির সঙ্গে রেখে পচিয়ে নিতে হবে। এতে উপাদানগুলো গেঁজিয়ে (ফারমেন্টেশন) যায়। এটিকে ছেঁকে নিয়ে পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং পরে বাকি শক্ত পদার্থটি পুকুরে ছড়াতে হবে। তবে সাধারণ পুকুরে বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাইলে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, বায়োফ্লক প্রয়োগের পরে আবার বেশি মাত্রায় চুন দিতে হয় (প্রতি ডেসিমাইলে ৩০০ গ্রাম) এবং পানিতে সার্বক্ষণিক এরেশান দিতে হবে বা পাম্প দিয়ে পানির ফোয়ারা দিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ৩০০০ লিটার পানি ধারনের জন্য ট্যাংকের সাইজ ৬ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৫০০০ লিটারের জন্য ৮ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৭৫০০ লিটারের জন্য ১০ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ফিট উচ্চতা, ১০০০০লিটারের জন্য ১৩ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ফিট উচ্চতা। অতঃপর ট্যাংকের সাথে এয়ার পাষ্পের সংযোগ ঘটাতে হবে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য। প্রতি ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ৭০ থেকে ৮০ ওয়াটের এয়ার পাম্প লাগবে এবং সাথে ৮ থেকে ১০টি এয়ার স্টোন প্রয়োজন হবে।

বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষে যে সব বিষয় নজর রাখতে হবে:

১. বায়োফ্লক পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা মাছচাষের ফলে উৎপাদিত বর্জ্যকে প্রেটিন সমৃদ্ধ জৈব খাবারে তৈরি করে। তাই সঠিক উৎস হতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করতে হবে।

২. নিয়মিত ট্যাংকে সরবরাহকৃত পানির গুণাগুণ যেমন-অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট, নাইট্রাইট, ফ্লকের ঘনত্ব ইত্যাদি পরিমাপ করতে হবে এবং এগুলো যদি সঠিক মাত্রায় না থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩. তাপমাত্রার হ্রাস বৃদ্ধিঃ আমাদের দেশে দিনের বেলার তাপমাত্রা ও রাত্রের তাপমাত্রা সব সময় উঠানামা করে, যা ফ্লকের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী নয়। তাই পর্যাপ্ত ফ্লকের বৃদ্ধির জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. বয়োফ্লকের মাধ্যমে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। কারণ এই প্রযুক্তিতে যদি পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ, ফ্লকের ঘনত্ব পরিমাপ ইত্যাদি বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান না থাকে তাহলে চাষি যে কোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৫. বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ট্যাংকে অধিক পরিমাণে মাছ রাখা হয়। তাই ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। আর ট্যাংকে সব সময় অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ লাগবে। তা না হলে ট্যাংকের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে সব মাছ এক সাথে মারা যেতে পারে। সর্বোচ্চ এক ঘন্টা ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ না করা হলে সব মাছ মারা যেতে পারে। তাই বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে।

(তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত)