মহিষ পালন ব্যবস্থাপনা
মহিষ পালনের সুবিধা:
গরুর মতো মহিষও আমাদের দেশে অতি পরিচিত গৃহপালিত প্রাণী। এদেশে কৃষিকাজ যথা হাল চাষ,ফসল মাড়াই এবং ভার বহনের জন্য অতীতে ব্যাপকভাবে মহিষ ব্যবহার করা হতো। কৃষিকাজ ও পরিবহন ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষিকাজে এবং ভার বহনের জন্য মহিষ ব্যবহার এদেশে বর্তমানে খুবই কম।খামারীরা তাই দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য মহিষ পালন করছে । মহিষের কিছু গুণাবলির জন্য শুধু বাংলাদেশের নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই গরুর চেয়ে মহিষ পালনের জন্য খামারীরা এগিয়ে এসেছেন । মহিষের এসব গুণাবলি হচ্ছে:
১। মহিষ সব পরিবেশেই বাস করতে পারে । সমতল ভূমি, জলাভূমি, মরুভূমি ও পাহাড় সর্বত্রই মহিষ পালন করা সম্ভব ।
২। মহিষ নিম্নমানের খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে ও কম গুণগতমানের খাদ্যকে পরিপাকের মাধ্যমে উন্নত গুণগতমানের দুধ উৎপাদন করতে সক্ষম। বাংলাদেশে পশুখাদ্যের অভাব প্রকট। এটি মহিষ পালনের বড় সুবিধা।
৩। গরুর তুলনায় মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী এবং কম খরচে মহিষ পালন করা যায়।
৪। মহিষ সারা বছর খোলা আকাশের নিচে থাকতে পারে। কাজেই মহিষের জন্য কোন বাসগৃহের প্রয়োজন হয় না ।
৫। যেসব স্থানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দুর্বল, সেসব স্থানে মহিষ পালন গরুর তুলনায় অনেক নিরাপদ। মহিষ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের লোনা পানি যেমন সহ্য করতে পারে তেমনি জোয়ার-ভাটার পানিতেও টিকে থাকতে পারে, বিশেষত ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে মহিষ দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটতে পারে। সুতরাং উপকূলীয় অঞ্চলের আবহাওয়ায় মহিষ একটি উপযুক্ত ও টেকসই প্রাণী।
৬। মহিষ ও মহিষের দুধ বাজারজাতকরণে কোন সমস্যা নাই ।
পুষ্টির চাহিদা মেটাতে মহিষ পালনে গুরুত্ব:
মহিষের দুধের পুষ্টিমান গরুর দুধের চেয়ে বেশি এবং মহিষের দুধ গরুর দুধের চেয়ে স্বাস্থ্যকর। মহিষের দুধে, আমিষ, খনিজ পদার্থ গরুর দুধের চেয়ে বেশি। মহিষের দুধের পুষ্টিমান ও অনেক বেশি। মহিষের দুধে গরুর দুধের তুলনায় ১১.৪২ শতাংশ প্রোটিন বেশি থাকে। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রনের পরিমানও মহিষের দুধে গরুর দুধের তুলানায় যথাক্রমে ৯২ শতাংশ, ৩৭.৭ শতাংশ এবং ১১৮ শতাংশ বেশি থাকে। ভিটামিন-এ এর পরিমাণও মহিষের দুধে বেশি থাকে।
অনুরূপভাবে মহিষের মাংসও গরুর মাংসের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর। আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে গুণগত মানের দিক দিয়ে গরুর মাংসের তুলনায় মহিষের মাংস বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। সকল লাল-মাংসের মধ্যে মহিষের মাংস স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। মহিষের মাংসে কোলেস্টেরল ও ক্যালরি কম থাকে; ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কম। মহিষের মাংসে কোলেস্টেরল মুরগির মাংসের চেয়ে কম। তাছাড়া মহিষের মাংস এলার্জিমুক্ত এবং কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মহিষের মাংসে চর্বির পরিমাণ কম থাকায় অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের জন্য মহিষের মাংসের চাহিদা বাড়ছে। মহিষের মাংসে উচ্চমাত্রার প্রোটিন মিনারেল ও ভিটামিন পাওয়া যায়; যা মানবদেহের জন্য উপকারী। ভিটামিন বি-১২ এর পরিমাণ অনেক বেশি পাওয়া যায়; যা শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। মহিষের মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ মুরগির চেয়ে বেশি। মহিষের মাংসে তুলনামূলকভাবে আয়রন বেশি থাকায় মানুষের দেহে রক্ত তৈরি করে ও রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক। মহিষের মাংসে (গরুর তুলনায়) কার্যকর আয়রন বেশি থাকায় গর্ভকালীন মায়েদের জন্য আয়রনের ঘাটতি মেটাতে বেশ কার্যকর।
বাংলাদেশের মহিষের জাত:
বাংলাদেশের মহিষের কোন স্বীকৃত জাত নেই। তবে ২টি টাইপ আছে: (ক) জলাভূমির মহিষ ও (খ) নদীর মহিষ
ক) জলাভূমির মহিষ: জলাভূমির মহিষ শুধু সিলেট বিভাগের জেলাসমূহে পাওয়া যায়। দেশের মোট মহিষের ১৪% জলাভূমির মহিষ। বয়স্ক মহিষের ওজন ৩০০-৩৫০কেজি হয়। এসব মহিষের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। এসব মহিষ পূর্বে কৃষিকাজ ও ভার বহনের কাজে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
খ) নদীর মহিষ: সিলেট বিভাগ বাদে অন্যান্য বিভাগে বিদ্যমান মহিষ নদীর মহিষ । বাংলাদেশের মোট মহিষের ৮৬% নদীর মহিষ । উৎপত্তি অনুসারে এসব মহিষকে মোট ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় । ১) আদি নদীর মহিষ ২) উন্নত নদীর মহিষ ,৩) সংকর জাতের নদীর মহিষ ।
১. আদি নদীর মহিষ (Babalus bubalis arnee): এ শ্রেণীর মহিষ অন্যদিক থেকে বাংলাদেশে বিরাজমান এবং অন্য কোন মহিষের দেখতে জলাভূমির ন্যায়, তবে এদের শিং জলাভূমির মহিষের তুলনায় সরু এবং শিং গোড়ার প্রশস্ততা জলাভূমির মহিষের শিং এর গোড়ার প্রশস্ততার চেয়ে কম । বয়স্ক মহিষের ওজন ২৫০-৩৩০ কেজি হয় । এদের দুধ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় যদিও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম । ২৭৪ দিনে মাত্র ৩২০-৩৩০ কেজি দুধ উৎপাদন করে ।
২. উন্নত নদীর মহিষ: ভারত থেকে বিভিন্ন সময় বেসরকারীভাবে আমদানীকৃত বিভিন্ন জাতের মহিষের মধ্যে সমাগম ও বাছাই এর মাধ্যমে দুধাল জাতের এ মহিষ সমূহের সৃষ্টি হয়েছে । পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর চরাঞ্চলে এ মহিষ সমূহ পালন করা হয় । এসব মহিষ অর্ধমুক্ত ব্যবস্থাপনায় পালন করা হয় । বয়স্ক মহিষের ওজন ৩০০-৫০০ কেজি হয় । দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩০০ দিনে ৭৫০-১১০০ কেজি।
৩.সংকর জাতের নদীর মহিষ: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দ্বীপসমূহের বিশেষত চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার দ্বীপসমূহে নীলিত রাভী ও Italian Mediterranean Buffalo জাতের মহিষের সংগে বাংলাদেশের আদি নদীর মহিষের মধ্যে ১৯৬০ থেকে চলমান শংকরায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে শংকর জাতের এসব মহিষ সৃষ্টি হয়েছে । এসব মহিষ দুধ উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করা হয়। ২৭০ দিনে এদের দুধ উৎপাদন ৫০০-৭০০ কেজি।
প্রজনন ব্যবস্থাপনা (Breeding system):
মহিষ পালনে প্রতিবছর একটি বাচ্চা পেতে হলে প্রজনন ব্যবস্থাপনার দিকে ভালোভাবে নজর দিতে হবে। যারা মহিষ পালন করছে তাদের প্রধান সমস্যা হল সঠিক সময়ে গাভী মহিষকে ভালো জাতের ষাঁড় মহিষ দ্বারা পাল দেয়া/কৃত্রিম প্রজনন করানো। এক্ষেত্রে পালনকারীরা নিজ খামারে ষাঁড় মহিষ রাখতে পারে অথবা সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে ভালো জাতের সিমেন (বীজ) পাওয়া গেলে কৃত্রিম প্রজনন করা যেতে পারে। তবে খামারিকে মহিষ প্রজননক্ষম (গরম) হবার লক্ষণ সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করতে হবে। লক্ষণ প্রকাশ পাবার ৮-১৮ ঘণ্টার মধ্যে মহিষকে পাল দিতে হবে। মহিষ গরম হবার লক্ষণ বোঝা তুলনামূলক কষ্টকর; বেশির ভাগ মহিষ নীরব হিট (Silent Heat) প্রদর্শন করে। এক্ষেত্রে যোনিপথে হালকা পাতলা মিউকাস দেখে বুঝতে হবে মহিষ প্রজননক্ষম/গরম হয়েছে। বেশির ভাগ (৮০-৮৫%) মহিষ সাধারণত দিনের শেষভাগ হতে রাত্রির শেষভাগে গরম হয়ে থাকে। তবে দিনে অল্পকিছু মহিষ (১০-১৫%) গরম হতে দেখা যায়। খামার/বাসা থেকে দূরে গিয়ে গাভী মহিষকে ষাঁড় দিয়ে প্রজনন করালে উক্ত স্থানে (৩০-৪০ মিনিট) কিছুক্ষণ গাভী মহিষকে অবসরে রাখতে হবে। অতপর খামারে ফেরত আনতে হবে। এক্ষেত্রে গাভী মহিষকে তাড়াহুড়ো করে বা দৌড়ে আনা যাবে না।
কৃত্রিম প্রজনন:
কৃত্রিম প্রজনন হচ্ছে কৃত্রিমভাবে ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ করে কৃত্রিমভাবে গাভীর জরায়ুতে ঢুকানো।
মহিষ কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা হচ্ছে: (১) একটি ভাল ষাঁড়ের বীজ দ্বারা অনেক গাভীকে পাল দেওয়া যায়, (২) যৌন রোগ প্রতিরোধ করা যায় ।
কৃত্রিম প্রজনন করানোর উপযুক্ত সময়:
কাম পর্ব শেষ হওয়ার ১০-১৪ ঘন্টা পর মহিষের ডিম্বাশয়ের ডিম্বস্থলন ঘটে । অন্যদিকে স্ত্রী জননতন্ত্রে শুক্রাণুর কার্যক্ষম জীবনকাল হচ্ছে ৩৬ ঘন্টা। তাই কাম পর্ব শেষ হওয়ার ৮-৯ ঘন্টা পূর্বে অথবা কাম পর্ব শুরু হওয়ার ১৬-২০ ঘন্টা পর কৃত্রিম প্রজনন করালে গর্ভধারণের হার বেশি হয় ।
“আপনার মহিষ গরম হলে বা ডাকে আসলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিস এবং ভেটেরিনারি হাসপাতালে খবর দিন এবং কৃত্রিম প্রজননের সুযোগ নিন ”
খাদ্য ব্যবস্থাপনা (Feeding Management) :
মহিষকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁচা ঘাস/সাইলেজ এবং প্রয়োজনমাফিক দানাদার খাদ্যমিশ্রণ সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়াও খাদ্যে লবণ ও খনিজ পদার্থ থাকতে হবে। মহিষের খাদ্যে বা রসদে ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য সহজপাচ্য, সহজলভ্য ও দামে তুলনামূলক সস্তা হতে হবে। এ লক্ষ্যে গমের ভুসি, ভুট্টা ভাঙ্গা, সয়াবিন মিল, খেসারি ভাঙ্গা, চাল ভাঙ্গা, সরিষার খৈল, কাঁচা ঘাস, খড় প্রভৃতি খাদ্য দ্রব্য মহিষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। মহিষের দৈহিক ওজনের ২.৫-৩% শুষ্ক খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে। আঁশজাতীয় (সবুজ ঘাস/সাইলেজ/হে/খড়) এবং দানাদার খাদ্য হতে এই শুষ্ক খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে। শুষ্ক পদার্থের এক-তৃতীয়াংশ দানাদার এবং দুই-তৃতীয়াংশ আঁশ জাতীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে। প্রতি কেজি গ্রহণকৃত শুষ্ক খাদ্যদ্রব্যের জন্য দিনে ৫-৬ লিটার পানি সরববরাহ করতে হবে। প্রতি কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য ৫-৬ গ্রাম ক্যালসিয়াম ও ২-২.৫ গ্রাম ফসফরাস সরবরাহ করতে হবে। ৪.২ মিলিগ্রাম সিলেনিয়াম (Se) এবং ৪২০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই (E) মিশ্রণ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ পোস্টপর্টাম হিট (PPH) ও বাচ্চা দেবার বিরতিকাল কমিয়ে দেয়। এছাড়াও খাদ্যদ্রব্যের সাথে জিংক প্রদানের মাধ্যমে দুধালো মহিষ হিট স্ট্রেস (Heat Stress) থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। মহিষকে আঁশজাতীয় খাদ্য ছোট ছোট করে কেটে প্রয়োজনীয় দানাদার মিশিয়ে প্রদান করলে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ খাদ্য দিনে দুই থেকে চারবার প্রদান করলে রুমেনের কার্যকারিতা সঠিক থাকে বিধায় দুধ উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। প্রতি কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য (চর্বি ৭%) ৬৩ গ্রাম পরিপাচ্য আমিষ (DCP), ০.৪৬০০ কেজি মোট পরিপাচ্য পুষ্টি (TDN), ৩.৩ গ্রাম ক্যালসিয়াম ও ২.৬ গ্র্রাম ফসফরাস সমৃদ্ধ রসদ তৈরি করতে হবে। মহিষ পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন বি ও সি এবং চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন কে তৈরি করতে পারে। তাই অন্যান্য ভিটামিন এ, ডি ও ই খাবারের সাথে বা আলাদাভাবে সরবরাহ করতে হবে। শুকনো খড় ও দানাদার মিশ্রিত রসদে প্রয়োজনীয় পরিপাচ্য আমিষ ও শক্তির পরিমাণ সঠিক থাকলেও ভিটামিন এ ও খনিজ পদার্থের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয় বিধায় প্রাণীকে ২৫০০০ আইইউ (IU) ভিটামিন এ ও ১০০ গ্রাম ডাইক্যালসিয়াম ফসফেট (DCP) প্রদান করতে হবে। প্রস্তাবিত দানাদার খাদ্য মিশ্রণ অনুসরণ করা যেতে পারে। ভুট্টা ভাঙা পাউডার ৩০%; খৈল (তিল/সয়াবিন/সরিষা) ৩০-৩৫%; গম/ধানের ভূসি ৩৫-৩৭%; খনিজ লবণ ২%; লবণ ১%। দুধের মহিষকে প্রতিদিন একই সময়ের ব্যবধানে খাবার প্রদান করতে হবে। ফলে রুমেনে নিয়মিত গাঁজন প্রক্রিয়া চলমান থাকে। এ লক্ষ্যে প্রাপ্ত রসদকে ৪টি ভাগে ভাগ করে সরবরাহ করা ভালো। দানাদার খাদ্য আঁশজাতীয় খাদ্যের সাথে মিশ্রিত করে মহিষকে সরবরাহ করলে খাদ্যের সর্বোচ্চ ব্যাবহার করতে পারে।
মহিষের সুষম খাদ্য প্রস্তুতের শর্তাবলী:
মহিষের রেশনে খাদ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবেঃ
১। সব খাদ্যদ্রব্য সহজলভ্য এবং দামে তুলনামূলকভাবে সস্তা হতে হবে ।
২। রেশনে ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য সুস্বাদু ও সহজপাচ্য হতে হবে ।
৩। রেশনে প্রয়োজনীয় পরিমাণ আঁশ জাতীয় আমিষ, ও খনিজ পদার্থ খাকতে হবে । প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সমূহ যাতে একাধিক খাদ্যদ্রব্য হতে আসে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। রেশন অবশ্যই সুষম হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকবে ।
৫। রেশন প্রয়োজনীয় পরিমাণ হতে হবে ।
মহিষের বিভিন্ন রোগ ও রোগের প্রতিকার:
মহিষকে সুস্থ রাখতে হলে সঠিক পুষ্টি প্রদানের পাশাপাশি নিয়মিত টিকা প্রদান ও কৃমির ঔষধ খাওয়াতে হবে। মাঠ পর্যায়ে মহিষের গলাফোলা রোগ বেশি দেখা যায়। তবে ক্ষুরা, তড়কা ও বাদলা রোগও দেখা যায়। এ জন্য এসব রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। টিকা প্রদানের মাধ্যমে মহিষকে উক্ত রোগসমূহ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।
মহিষের কৃমিজনিত সমস্যা: মহিষ যেহেতু খেতে পছন্দ করে ফলে শরীরে সাধারণত বহিঃপরজীবী ও অন্তঃপরজীবী আক্রমন বেশি হয়ে থাকে ।
১.বহিঃপরজীবী: বহিঃপরজীব বলতে আঠালী, উকুন, প্রভৃতিকে বুঝায় যাদের আক্রমনে মহিষের রক্তক্ষরণ ও উৎপাদন কম হয়ে থাকে । বহিঃপরজীবির আক্রমন থেকে মহিষকে রক্ষা করতে হলে মহিষকে নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে । এছাড়া মহিষকে যথাযথ বহিঃপরজীবী নাশক ব্যবহার করতে হবে । কিছু ঔষধ পানিতে মিশিয়ে মহিষকে গোসল করাতে হয় অপরদিকে কিছু ঔষধ আছে যা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
২.অন্তঃপরজীবী: অন্তঃপরজীবী বলতে মহিষের শরীরের ভিতরের কৃমির ক্ষতিকর প্রভাবকে বুঝানো হয়েছে । কৃমিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: (a) গোল কৃমি (b) পাতা কৃমি বা কলিজা কৃমি ও (c) ফিতা কৃমি । এসব কৃমির আক্রমনে মহিষের ব্যাপক ক্ষতি করে –
i. শরীরে পুষ্টি শোষণ করে পুষ্টিহীনতার কারণ ঘটায় ।
ii. শরীরের অভ্যন্তরীন অঙ্গের রক্তক্ষরণ ঘটায় ও ক্ষত সৃষ্টি করে ।
iii. স্বাস্থ্যহীনতা, রুচিহীনতা ও রক্তস্বল্পতার অন্যতম কারণ কৃমি।
iv. শরীরের পশম উস্ক-খুশকো থাকা, ধিরে ধিরে দুর্বলতার লক্ষণ ছাড়াও গলকম্বলের নীচে পানি জমা একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণও কৃমির আক্রমণ।
v. কৃমির আক্রমনে মহিষের কোষ্ঠকাঠিন্ন বা পাতলা পায়খানা হতে পারে । অনেক সময় গোবরের সাথে স্বল্প পরিমাণ আম, মিউকাস বের হতে পারে।
প্রতিকার:
প্র্রতিকার হিসাবে মহিষকে প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর অথবা বছরে কমপক্ষে দুইবার কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে বা ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হবে। পশুর গোবর পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী কৃমিনাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
মহিষের রোগ প্রতিরোধে টিকার ব্যবহার:
কৃত্রিম উপায়ে কোনো রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঐ রোগের জীবানু দ্বারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে প্রতিষেধক তৈরি করা হয় তাহাই টিকা। মহিষের টিকা প্রদান কর্মসূচি:
টিকার নাম |
মাত্রা ও প্রয়োগবিধি |
সংরক্ষণ |
তড়কা |
৪ মাস বয়সের মহিষে ১মিলি চামড়ার নিচে, প্রতিবছর ১বার |
৪০থেকে ৮০সেন্টিগ্রেড |
গলাফুলা |
৬মাস বয়সের মহিষে ১ মিলি চামড়ার নিচে, প্রতি বছর ২বার |
৪০থেকে ৮০সেন্টিগ্রেড |
ক্ষুরারোগ |
৪মাস বয়সের মহিষে মনোভ্যালেন্ট ৩মিলি,ডাইভ্যালেন্ট ৬মিলি, ট্রাইভ্যালেন্ট-৯মিলি গলার চামড়ার নিচে । ৪-৬ মাস পর ব্যবহার করতে হয় । |
৪০থেকে৮০সেন্টিগ্রেড |
বিভিন্ন বয়সের মহিষের যত্ন:
উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে মহিষের যত্নের তারতম্য দেখা যায়। নিম্নে বিভিন্ন বয়স ও উৎপাদন পর্যায়ের মহিষের যত্ন সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
ক: বাছুরের যত্ন
১। বাছুর জন্মের পর বাছুরকে মায়ের সাথে রাখতে হবে এবং বাছুর যাতে মায়ের দুধ পান করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২। বাছুরকে শুকনা পরিষ্কার স্থানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। বাছুরের বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত দু-বেলায় মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এক মাস পর বাছুরকে অল্প অল্প দানাদার খাদ্য, তিন মাস পর তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে।
৪। একুশ দিন বয়সে, বিয়াল্লিশ দিন বয়সে ও নব্বই দিন বয়সে গুড়া কৃমির ঔষধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাস বয়সের আগে বাছুরকে কোন রোগের টীকা দেওয়া যাবে না।
খ. দুদ্ধবতী গাভীর যত্ন:
১. প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুধালো মহিষের ঘর পরিষ্কার করতে হবে ও মহিষকে ২-৩ বার গোসল করাতে হবে। ঘরের আবর্জনা (মলমূত্র) দূরবর্তী গর্তে ফেলতে হবে। সকালে ঘর পরিষ্কার করার পর মহিষকে গোসল দিতে হবে। পরবর্তীতে প্রয়োজনমাফিক দানাজাতীয় খাবার ও পরিষ্কার পানি প্রদান করতে হবে। অতঃপর দুধ দোহন শেষ হওয়ার পর সবুজ ঘাস/সাইলেজ/হে/শুকনো খড় সরবরাহ করতে হবে। দুপুরেও মহিষের ঘর পরিষ্কার করে মহিষকে গোসল দিতে হবে এবং প্রযোজনমাফিক আঁশজাতীয় খাদ্য প্রদান করতে হবে। পানির পাত্রে সব সময় পরিষ্কার পানি রাখতে হবে। বিকালে দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হবে। গরমের দিনে বিকালে পানির ঝাপটা অথবা গোসল করাতে হবে। দিনের দৈর্ঘ্যের সাথে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ নির্ভর করে। শীতের সময় শুষ্কখাদ্য গ্রহণের পরিমাণ দৈহিক ওজনের ১.৪-১.৮% হয়ে থাকে এবং গরমের সময় ২.২-৩.০% হয়ে থাকে । তাই সন্ধ্যা বেলা ঘরের লাইট জালালে খাদ্য গ্রহণের সময় বৃদ্ধি পায় ফলশ্রুতিতে উৎপাদন সঠিক থাকে।
২. দুধ দোহনের ঘরে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে লাইনের মাধ্যমে একা যাওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে গাভীকে পূর্বে ৩-৪ বার বাচ্চা প্রদানকারী গাভীর সঙ্গে রাখা যেতে পারে। গাভীর জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট করতে হবে এবং প্রতিদিন একই স্থানে রেখে দুধ দোহন করতে হবে। বাচ্চা প্রসবের ১৫-২০ দিন পূর্ব হতেই গোয়ালাকে গাভীর কাছে প্রতিদিন কিছু সময় কাটাতে হবে। এ সময় গোয়ালা গাভীর পিঠ, ওলান এবং বাটে আলতো/নরম ভাবে হাত বুলাতে থাকবে। এর ফলে গোয়ালা গাভীর কাছে পরিচিত হয়ে যাবে এবং অতি সহজেই দুধ দোহনের কাজ করতে পারবে।
৩. প্রথম বাচ্চা প্রসবের পর ওলান খুব স্পর্শ কাতর থাকে। সুতরাং খুব নরম হাতে দোহনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
৪. দুধদোহন কাজ সম্পন্ন হলে গাভীকে পর্যায়ক্রমে দুধ দোহনের ঘর হতে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
গ. গর্ভবতী গাভীর যত্ন:
গর্ভবতী গাভীর বিশেষভাবে যত্নের প্রয়োজন হয়। গর্ভধারণ কালের শেষ চতুর্থাংশ সময়ে গাভীর যাতে কোনরুপ অসুবিধা না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
১. গর্ভবতী গাভী দুগ্ধ উৎপাদনের ধাপে থাকলে বাচ্চা প্রসবের ৬-৮ সপ্তাহ পূর্বেই দুগ্ধ দোহনের কাজ বন্ধ করতে হবে। গর্ভবতী গাভীকে প্রসূতি ঘরে স্থানান্তর করতে হবে। প্রসূতি ঘরের মেঝের আয়তন গাভী প্রতি ৯-১০ ব.মি. হতে হবে।
২. গাভীকে বাচ্চা প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত ভালমানসম্পন্ন কাঁচা ঘাস এবং ২-৩ কেজি পরিমাণ দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ খাওয়াতে হবে।
৩. প্রসবের ৩-৫ দিন পূর্বে গাভীকে জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্রসূতি ঘরে স্থানান্তর করতে হবে।
৪.গর্ভবতী গাভীকে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাওয়ানো ও টিকা প্রদান করা যাবে না।
৫. বাচ্চা প্রসবের পর একটি পাত্রে পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি খাওয়াতে হবে। এরপর ভূষি, ভাঙ্গা গম অথবা কর্ন, গুড়, লবণ, আদা এবং সামান্য পরিমাণ খনিজ জাতীয় খাদ্য উপাদান সমন্বয়ে তৈরিকৃত ম্যাশ/জাউ খাওয়াতে হবে। এতে করে গাভীর পেট পরিষ্কার হবে এবং শরীরে শক্তি ফিরে আসবে, বাচ্চা প্রসবের ৪-৬ ঘণ্টার মধ্যে গর্ভফুল যদি না পড়ে তবে অবশ্যই রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তারকে ডাকতে হবে।
৬. বাচ্চা প্রসবের ৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাত বাছুরকে মায়ের দুধের বাট চুষতে দিতে হবে যাতে নবজাত বাচুর জন্মের ৪ ঘণ্টার মধ্যে কলস্ট্রাম বা শাল দুধ খেতে পারে।
(ঘ) প্রজননের জন্য এঁড়ে বাছুরের যত্ন
১. ৫-৬ মাস বয়সের এঁড়ে বাছুর ভবিষ্যতে প্রজননের জন্য বাছাই করতে হবে। বাছাই করা এঁড়ে বাছুর আলাদা করতে হবে। গলায় দড়ি ব্যবহার করে সহজ এবং সাধারণভাবে চলাফেরার অভ্যাস করাতে হবে।
২. ৫-৬ মাস বয়সের পর হতেই প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করাতে হবে। ব্যয়ামের সময় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে ১ ঘণ্টায় উত্তীর্ণ করতে হবে। কারণ, প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড়ের জন্য প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ব্যায়াম করানো প্রয়োজন হয়।
৩. সহজভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ষাঁড়কে ৮-১২ মাস বয়সেই নাকে ধাতব রিং অথবা দড়ি (Rope string) পরাতে হবে।
উপসংহার: মহিষ পালনের ফলে দেশে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, জনগণ নিরাপদ ও উচ্চ মানসম্পন্ন আমিষ পাবে, জনগণের পুষ্টির ঘাটতি মিটবে এবং খামারিদের আয় বাড়বে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। ভারত, পাকিস্তান এবং মহিষ পালনে অগ্রগামী দেশসমূহে মোট দুধ উৎপাদনের ৫০ থেকে ৬৫ ভাগ আসে মহিষ থেকে। আমাদের দেশে মহিষ থেকে দুধ আসে মাত্র ৪ শতাংশ। মহিষ থেকে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে পারলে অতি সহজেই আমরা দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি।