প্রাণিসম্পদ খাতের প্রযুক্তি

ঘাসভিত্তিক টিএমআর প্রযুক্তি

Amir Hossain | ১৬ মে ২০২৪

ঘাসভিত্তিক টোটাল মিক্সড রেশনের মাধ্যমে কম খরচে খাসি হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রযুক্তি

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬৯.৪৫ লক্ষ ছাগল রয়েছে (ডিএলএস, ২০২২-২৩)। আমাদের দেশ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.০৮ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি হারাচ্ছে। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে সীমিত কৃষি জমি বারবার ‍ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে পতিত জমি বা চারণভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। পতিত জমি বা গোচারণ জমি কমে যাওয়ায় প্রান্তিক কৃষকরা খোলা পদ্ধতিতে ছাগল পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তাছাড়া ছাগলের হ্রষ্টপুষ্টকরণের জন্য সুষম রেশন সরবরাহ করা খুবিই গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বন্ধ/স্টল সিস্টেমে ছাগল পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের দাবি, ছাগলের হৃষ্টপুষ্টকরণের জন্য সুষম রেশন দিতে হবে।

ঘাস ভিত্তিক টিএমআর

ঘাস ভিত্তিক টোটাল মিক্সড রেশন (টিএমআর) যাম ছাগলের খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। সর্বোপরি, ঘাস ভিত্তিক কম খরচে টিএমআর খাওয়ানোর জন্য ক্যাস্ট্রেটেট পুরুষ/খাসী ছাগল হৃষ্টপুষ্টকরণের পাইলাটিং কার্যক্রম বিএলআরআই শুরু করেছে। চাহিদাযোগ্য বৃদ্ধির হার অর্জন করা এবং লালন-পালনের খরচ এবং হৃষ্টপুষ্টকরণের সময়সীমা হ্রাস করা, অন্যদিকে যা ছাগল হৃষ্টপুষ্টকরণের মডেল উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে এবং মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি করবে । এমন বাস্তবতায়, একটি খাসী ছাগল বাজার জাত করার জন্য উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত ঘাস ভিত্তিক কম খরচে টিএমআর খাওয়ানোর মডেল পাইলটিং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

টিএমআর প্রস্তুত প্রণালী

টিএমআর প্রযুক্তিতে ৬০ ভাগ রাফেজ (আশযুক্ত কাচাঘাস যেমন-জার্মান, নেপিয়ার ইত্যাদি) এবং ৪০ ভাগ দানাদার খাবারের সংমিশ্রনে তৈরী করা হয়েছে। প্রতি একশত কেজি টিএমআর তৈরীতে গমের ভূসি ৩২ ভাগ, খেসারী ভূসি ২০ ভাগ, সয়াবীন ভাঙ্গা ৪০ ভাগ, চিটাগুড় ৪ ভাগ এবং ডিসিপি ৩ ভাগ দরকার হয় (কাঁচাঘাসে ১০-১৬% এবং দানাদার খাবারে ২২% আমিষ থাকে)। কাঁচাঘাস সতেজ অবস্থায় হাত বা মেশিনের সাহায্যে ২-৩ ইঞ্চি পরিমাণ ছোট করে নিতে হবে, খাসী ছাগলের দৈহিক ওজন অনুযায়ী নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে রাফেজ এবং দানাদার খাবার দৈনিক দুইবার সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে। গবেষণার শুরুতেই ছাগলের প্রারম্ভিক ওজন রেকর্ড করা হয়েছিল, পরবর্তীতে ১৫ দিন পরপর  সকালে খাবার দেওয়ার পূর্বে ওজন পরিমাণ করে রেকর্ড করা হয়েছিল। সংগৃহীত তথ্যসমূহ পরিসংখ্যানগতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল ।

স্বারণি: ওজন ভিত্তিক জীবন্ত খাসি ছাগলের দৈনিক আঁশ জাতীয় ও দানাদার খাবারের পরিমাণ

পরিমাণ

০৫ কেজি খাসীর জন্য

১০ কেজি খাসীর জন্য

২০ কেজি খাসীর জন্য

কাঁচাঘাস

৭৫০ গ্রাম

১.৫ কেজি

৩ কেজি

দানাদার খাবার

১১৮ গ্রাম

২৩৬ গ্রাম

৪৭২ গ্রাম

চিটাগুড়

৫০ গ্রাম

১০০ গ্রাম

২০০ গ্রাম

 

ঘাস ভিত্তিক টিএমআর ফলাফল

গবেষণায় দেখা যায় যে, ৬ থেকে ৯ মাস বয়সের খাসী ছাগলগুলোর দেহিক ওজন বেশী হয়েছে। হৃষ্টপুষ্টকরণের প্রক্রিয়াটি ফলাফলে কমলাপুরে, রাজশাহী এবং বিএলআরআই-এ তে গড়ে দৈনিক ওজন হয়েছিলো নিযন্ত্রণ গ্রুপ, ৩-৬, ৬-৯ এবং ৯-১২ মাস এর ৫৭.৭৯, ৭০.৩২, ৭২.৪৫, ৭০.২৮ এবং ৫০.২৭, ৭৬.১১, ৭১.১১, ৬৭.৪ গ্রাম/দিন, গড়ে দৈনিক ওজন হয়েছিলো।

প্রযুক্তির আর্থিক সুবিধাসমূহ

টিএমআর প্রযুক্তিটি সারাবছর সব ধরণের বৈরী আবহাওয়ায়ও ব্যবহার উপযোগী। খাসী ছাগলকে কোনো ধরনে গ্রোথ প্রোমোটার অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক ও ফিড অ্যাডিটির সরবরাহ করা হয়নি। সাধারণত ১৮ কেজি জীবন্ত ওজনের একটি খাসী ছাগলের প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ৫২০ টাকা । আবার ২০ কেজি জীবন্ত ওজনের একটি খাসী ছাগলের প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ৬৫০ টাকা। ২০-২৫ কেজি জীবন্ত ওজন বিশিষ্ট একটি খাসী ছাগলের প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ৮৫০ টাকা। ২৫-৩০ কেজি জীবন্ত ওজন বিশিষ্ট একটি খাসী ছাগলের প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ১০০০ টাকা। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮ কেজি মাংস বিশিষ্ট খাসী ছাগলের চর্বি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম, মাংস সুস্বাদু ও  সহজে  পরিপাচ্য যা অন্যান্য ওজন বিশিষ্ট খাসী ছাগলে পাওয়া যায় না, তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি আছে এবং স্থুলতা জনিত নানাবিধ সমস্যা রয়েছে সেই সমস্ত ভোজন রসিকদের খাদ্য তালিকায় ১৮কেজি ওজন বিশিষ্ট খাসীর মাংস রাখা যেতে পারে। এছাড়া চর্বি ও কোলেস্টেরল সচেতন উন্নত বিশ্বের মানুষের মাঝে এই ধরনের মাংস রপ্তানী করে বৈদেশীক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।

টিএমআর এর উপকারিতা

আমাদের দেশে দিন দিন জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফলে ছাগলের চারণভূমির সংকট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় টিএমআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ছাগল পালনকারী খামারী খুব সহজেই এই সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে পারবে। টিএমআরে খাদ্যের সকল পুষ্টি গুণাগুণ প্রায় সুষম পর্যায়ে থাকে। এই মিশ্রণ থেকে খাবার বাছাই করে খাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা বিধায় খাবার অপচয় কম হয়। এই পদ্ধতিতে খাদ্যের পরিপাচ্যতা বাড়ায় যার দ্বারা ছাগলের মাংস উৎপাদন অর্থাৎ দৈনিক বৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। ফলে খাদ্যে খরচ কমে গিয়ে খামারের আয় বেড়ে যায়। এই পদ্ধতিতে ছাগলের মৃত্যুহার নেই বললেই চলে এবং খুব সহজেই সুঠামদেহী ছাগল বাজারজাত করা যায়।

 টিএমআর এর সতর্কতা:

ছাগল হৃস্টপুস্ট করার জন্য টিএমআর প্রস্তুত করার সময় খাদ্য উপাদানের গুণাগত মান পরীক্ষা করে নিতে হবে। টিএমআর এ কাচাঘাস সরবরাহ করার পূর্বে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন রাসায়নিক সার ব্যবহারের পর কমপক্ষে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দানাদার খাবারে কোন ধরনের মোল্ড, ফাঙ্গাস না থাকে। দুর্গন্ধযুক্ত ও পচে যাওয়া উপকরণ  খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। টিএমআরে ব্যবহৃত চিটাগুড় মিষ্টি বিধায় পিপড়া, মাছি, তেলাপোকা ইত্যাদি আসতে পারে তাই প্রস্তুতকৃত টিএমআর ছায়া যুক্ত স্থানে ভালভাবে ঢেকে রাখতে হবে। প্রতিদিনের টিএমআর প্রতিদিন প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রস্তুতকৃত টিএমআর এর সকালের অংশ সকাল  ৮-৯ টার মধ্যে এবং বিকেলের অংশ ৩-৪ টার দিকে সরবরাহ করতে হবে। ব্যবহৃত পানির পাত্র সবসময়  পরিস্কার রাখতে হবে।

 উপসংহার

প্রত্যাশিত দৈনিক বৃদ্ধির হার, খাসী পালনের খরচ কমানো এবং হৃষ্টপুষ্টকরণের সময়সীমা হ্রাস করার জন্যে এই গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগানো যেতে পারে। অন্যদিকে যা ছাগল হৃষ্টপুষ্ট মডেলের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মাংস উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।