মাছ চাষ

দেশি সরপুঁটি মাছের কৃত্রিম প্রজনন পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

Md Alamin Sarker | ১৬ মে ২০২৪

দেশি সরপুঁটি মাছের কৃত্রিম প্রজনন পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

মানুষের আমিষের প্রধান উৎস মাছ হওয়া সত্ত্বেও মাছ তথা জলজ পরিবেশ আজ বিভিন্ন কারনে সংকটাপন্ন। বিভিন্ন সমীক্ষা হতে জানা যায় যে, স্বাদুপানির শতকরা ২০ ভাগ প্রজাতি আজ নানা কারণে বিলুপ্ত, বিপন্ন বা সংকটাপন্ন। ফলশ্রুতিতে, মাছের জীববৈচিত্র্য বিশেষত মিঠাপানির জলাশয়সমূহ হতে মাছের প্রজাতির দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে মাছের প্রজননক্ষেত্র ও বাসস্থান প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি আইইউসিএন বাংলাদেশ ৬৪ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ সংকটাপন্ন/বিপন্ন হিসেবে বিহ্নিত করেছে। এদের মধ্যে মহাশোল, গনিয়া, দেশী সরপুঁটি, বাটা, কালিবাউস, শোল, কৈ, ভাগনা, গুজি আইড়, পাবদা, গুলশা, বাইম, চিতল, ফলি এবং কুচিয়া উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণের নিমিত্ত এসব মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে ইনস্টিটিউট বিপন্ন দেশী সরপুঁটি মাছের প্রজনন এবং পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করেছে।

কৃত্রিম প্রজনন কৌশলঃ

পরিপক্কতাঃ দেশী জাতের সরপুঁটি মাছ প্রথম বছরেই পরিপক্কতা লাভ করে ও বছরে একবার প্রজনন করে থাকে। এ মাছের প্রজননকাল মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ডিম ধারণক্ষমতা ও ডিমের ধরণঃ পরিপক্ক ডিম হালকা সবুজ থেকে তামাটে বর্ণের হয়। নিষিক্ত ডিম আঠালো হয় এবং নিমজ্জিত তৃণ ও আগাছা ইত্যাদিতে লেগে থাকে। সরপুঁটি মাছের লিঙ্গ অনুপাত ১:১ বা এর কাছাকাছি হয়।

ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও লালনঃ

  • দেশী সরপুঁটি মাছের ব্রুড মাছকে লালনের জন্য ২০-৩০ শতাংশের পুকুর সবচেয়ে উপযোগী
  • মাছ মজুদের পূর্বে পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে
  • পোনা উৎপাদনের জন্য প্রজনন ঋতুর ৪-৫ মাস আগে থেকেই প্রাকৃতিক উৎস হতে ১০০-২০০ গ্রাম ওজনের ব্রুড মাছ সংগ্রহ করে পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে
  • ব্রুড পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫-২০ কেজি মাছ মজুদ করা যেতে পারে
  • খাবার হিসেবে এ সময়ে চাউলের কুঁড়া, গমের ভূষি, সরিষার খৈল, ফিশমিল ও ভিটামিন প্রিমিক্সের মিশ্রণ অথবা বাজারে প্রাপ্ত ২৮-৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ভাসমান পিলেট খাদ্য মাছের দেহ ওজনের ৩-৫% হারে দিতে হবে। তাছাড়া পুকুরের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি সপ্তাহে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে
  • পুকুরে নিয়মিতভাবে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে
  • ব্রুড পুকুরে নিয়মিত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়

পোনা উৎপাদন

  • পোনা উৎপাদনের জন্য সরপুঁটি মাছের স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কে একটি করে পিটুইটারি দ্রবণের (পিজি) ইনজেকশন দেয়া হয়
  • সরপুঁটি মাছের প্রজননের জন্য ইনজেকশন দেয়ার ৬-৭ ঘন্টা পূর্বে ব্রুড মাছ ধরে হ্যাচারিতে ট্যাংকে রাখতে হবে
  • পুঁটি মাছের লাফিয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি বিধায় মাছ রক্ষিত ট্যাংক অবশ্যই জাল দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হয়
  • এ সময় পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিশ্চিত করার জন্য হাপায় অথবা ট্যাংকে অনবরত পানির প্রবাহ থাকলে ভালো হয়। নিম্নে হরমোন প্রয়োগের মাত্রা দেয়া

মাছের লিঙ্গ

হরমোন প্রয়োগ মাত্রা (মিগ্রা./কেজি)

মন্তব্য

স্ত্রী

৪,০-৫.০

এ মাছের ক্ষেত্রে একটি মাত্র হরমোন ইনজেকশন দিতে হয়

পুরুষ

২.০

 

  • ইনজেকশন দেয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ১:১ অনুপাতে সিমেন্টেড ট্যাংকে গ্লাস নাইলন হাপায় রেখে পানির কৃত্রিম ঝর্ণা প্রবাহ দিতে হবে
  • স্ত্রী পুরুষ উভয় মাছকে পেক্টোরাল পাখনার নীচের মাংসে ইনজেকশন দেয় হয়
  • সাথারণত ৬-৭ ঘন্টা পর স্ত্রী মাছ প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে ডিম দিয়ে থাকে
  • ডিম ছাড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব রুড মাছগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে
  • ব্রুড মাছগুলোকে ১ পিপিএম মাত্রায় পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করিয়ে পুকুরে ছেড়ে দেয় হয়
  • সাধারণত ১৮-২০ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয়
  • ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাপাতেই ২-৩ দিন রাখতে হয়
  • সাধারণত ৬০-৭২ ঘন্টার মধ্যে রেণু পোনার ডিম্বথলি নিঃশেষিত হয়
  • ডিম্বথলি নিঃশেষ হওয়ার ২-৩ ঘন্টা পূর্ব থেকেই খাবার হিসেবে এদেরকে মুরগির ডিম পূর্ণ সিদ্ধ করে তার কুসুম ১-২ দিন খাওয়াতে হবে
  • এক বা দুই দিন পর উক্ত রেণু পোনা নার্সারী পুকুরে লালনের জন্য উপযুক্ত হয়

নার্সারি ব্যবস্থাপনা

  • দেশী সরপুঁটি মাছের পোনার নার্সারিতে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ঃ
  • দেশী সরপুঁটি মাছের নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হলে ভালো হয়
  • প্রস্তুতির সময় পুকুর ভালোভাবে ৫-৭ দিন শুকিয়ে নিতে হয়
  • পুকুরের তলদেশ মই দিয়ে সমতল করতে হবে
  • অতঃপর প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে
  • চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে
  • সার দেয়ার ৩ দিন পর ১ কেজি ময়দা পানিতে গুলে প্রতি শতাংশে দিতে হবে
  • খাবার দেয়ার পরপরই পুকুরে হাঁস পোকা জন্মায়
  • হাঁস পোকা নিধনের জন্য প্রতি শতাংশে ১০ মিল, সুমিথিয়ন রেণু ছাড়ার ২৪ ঘন্টা পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে
  • রেণু ছাড়ার পূর্বে পুকুরের পানিতে বিষাক্ততা রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে
  • প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ গ্রাম রেনু পোনা ছাড়া যায়
  • রেণু মজুদের পর নিম্নবর্ণিত সারণি অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করতে হবে

সারণি ১. নার্সারি পুকুরে খাদ্য সরবরাহের তালিকা

সময়কাল

খাদ্য

প্রয়োগের সময়

১-৩ দিন

১ কেজি রেণুর জন্য ১ কেজি ময়দা ও ৮-১০ টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে

তিন বার

৪-৭ দিন

১ কেজি রেণুর জন্য ১ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবণ দিতে হবে

দিন ০২ বার

৮-১০ দিন

১ কেজি রেণুর জন্য ১ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবণ দিতে হবে

দিন ০২ বার

১১-১০ দিন

১ কেজি রেণুর জন্য ১.৫ কেজি নার্সারী খাবার দিতে হবে

দিন ০২ বার

১৬-২০ দিন

১ কেজি রেণুর জন্য ২.০ কেজি নার্সারী খাবার দিতে হবে

দিন ০২ বার

এভাবে নার্সারি করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ২.০-২.৫ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা সম্ভব

দেশী সরপুঁটি মাছের চাষ

পুটি মাছ একক কিংবা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। তবে একক চাষের থেকে মিশ্র চাষ অধিক লাভজনক।

পুকুর প্রস্তুতি

  • সরপুঁটি মাছের একক চাষের জন্য ১০-২০ শতাংশ মাপের এবং রুইজাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষের জন্য ৫০-৬০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করাই উত্তম
  • পুকুরের গভীরতা ৪-৫ ফুট হতে হয়
  • মাছ মজুদের পূর্বে পুকুরের পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে, আগাছা পরিস্কার ও রাক্ষুসে মাছ দমন করতে হবে
  • এরপর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে
  • চুন প্রয়োগের পর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পরে পানির রং হালকা বাদামি হলে মাছ মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে

পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা

দেশী সরপুঁটি মাছের একক মিশ্র চাষের জন্য ৩-৪ সেমি. আকারের পুঁটি মাছের, ৮-১০ সেমি, আকারের রুই জাতীয় মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে

সকালে বা বিকালে যখন সূর্যের তাপ কম থাকে তখন পুকুরে মাছ মজুদের কাজ করতে হবে

সারনি ২. দেশী সরপুঁটি মাছের একক ও মিশ্র চাষ পদ্ধতি

মাছের প্রজাতি

পদ্ধতি-১

পদ্ধতি-২

প্রতি শতকে

মজুদ সংখ্যা

উৎপাদন (কেজি)

মজুদ সংখ্যা

উৎপাদন (কেজি)

দেশী স্বরপুঁটি

৪০০

২০-২২

৩০০

১৫-১৬

রুই

-

-

৪-৫

কাতলা

-

-

৩-৪

সিলভার

-

-

২-৩

মৃগেল

-

-

১-২

মোট

৪০০

২০-২২

৩২০

২৫-৩০

 

খাদ্য ব্যবস্থাপনা

  • পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ ভাসমান পিলেট দিনের বেলায় ২ বার প্রয়োগ করতে হবে
  • একক/মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে
  • খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তর এক দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। অত্যন্ত শীত এবং বৃষ্টির দিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে

ব্যবস্থাপনা

 

অপেক্ষাকৃত ভাল উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবেঃ

  • পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রতি মাসে সঠিক মাত্রায় চুন ও লবন ব্যবহার করা
  • নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করা
  • প্রতি সপ্তাহে একবার হররা টানতে হবে
  • পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা
  • পানির স্বচ্ছতা ২০ সেমি. এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে

মাছের আহরণ ও উৎপাদন

  • পুকুরে ৬-৮ মাস লালনের পর মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হয়
  • প্রথমে পুকুরে ভালোভাবে জাল টেনে এবং পরবর্তিতে পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ আহরণের ব্যবস্থা করতে হয়
  • দেশী স্বরপুটি মাছ একক চাষ থেকে একর প্রতি ২০০০-২২০০ কেজি এবং মিশ্র চাষ থেকে একর প্রতি ২৫০০-৩০০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব