ঝিনুক চাষ

ঝিনুক চাষ (মুক্তার জন্য)

Jakia sultana | ১৬ মে ২০২৪

বাংলাদেশের মিঠাপানির জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। জলবায়ুও মুক্তা চাষের উপযোগী। প্রায় ১০ মাস উষ্ণ আবহাওয়া থাকায় ঝিনুকের বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের পরিবেশও অনুকূল এখানে। চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যান্য দেশে প্রনোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদন এবং চাষ করা হয়ে থাকে। চীন ও জাপান দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক গবেষণায় মুক্তা চাষে পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বাংলাদেশও প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদনে সফল হয়েছে। এই সাফল্যকে বাণিজ্যিকভাবে বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে দেশের প্রথম মুক্তা গবেষণাগার। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটে স্থাপিত এ গবেষণাগার মুক্তা উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বাংলাদেশে মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক

মুক্তা জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভিতরে জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরণের রত্ন। মুক্তা তৈরি করতে পারে এমন ৪ টি প্রজাতির ঝিনুক বাংলাদেশে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব ঝিনুক ম্বাদু পানিতে যেমন পুকুর-দীঘি, খাল- বিল, নদী- নালা, হাওর- বাওড় ইত্যাদিতে পাওয়া যায়।

ল্যামেলিডেনস মারজিনালিস

ল্যামেলিডেনস করিয়ানাস

ল্যামেলিডেনস ফেঞ্চুগ্যানজেনসিস

ল্যামেলিডেনস জেনকিনসিয়ানাস

 

  মুক্তা উৎপাদন পদ্ধতি

  • ম্যান্টল টিস্যু অপারেশন পদ্ধতি : এই অপারেশন দুটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। প্রথমে ম্যান্টল টিস্যুর টুকরা তৈরি করা হয়, তারপর ঝিনুকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এক্ষেত্রে অপারেশনের জন্য ১-২ বৎসর বয়সের ঝিনুক (৬-৮ সেমি.) স্বাস্থ্যবান এবং শক্ত ঝিনুকের ম্যান্টল টিস্যুও কিনারার দিক থেকে টিস্যু সংগ্রহ করতে হবে। টিস্যু সংগ্রহের সময় ঝিনুকটি সম্পূর্ণ খুলে বা ফাঁক করে কেটে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এভাবে বিচ্ছিন্ন করা টিস্যু একটি গ্যাস বোর্ডে রেখে ছোট ছোট টুকরা করে কাটতে হবে। প্রতিস্থাপনের জন্য অপর একটি শক্ত স্বাস্থ্যবান ও প্রশস্ত ঝিনুকের দুটি খোলস ৮-১০ মিমি পর্যন্ত ফাঁক করতে হবে। দুই খোলসের মাঝে কাঠের কীলক স্থাপন করতে হবে যাতে খোলস দুটি বন্ধ হয়ে না যায়। ঝিনুকের পেছন দিকের মাংশল ম্যান্টলের বহিঃপ্রান্তে টিস্যু প্রতিস্থাপন করা ভাল। প্রতিস্থাপনের জন্য প্রথমেই হুক এবং নিডল এর সাহায্যে এক টুকরা ম্যান্টল টিস্যু নিতে হবে। উলম্বভাবে ঝিনুকের ম্যান্টলে একটি গর্ত করে তাতে টুকরাটি স্থাপন করতে হবে। এভাবে পেছন থেকে সামনের দিকে একের পর এক টুকরা ম্যান্টল টিস্যু স্থাপন করতে হবে। ঝিনুকের আয়তন অনুযায়ী যে কয়টি টুকরা প্রতিস্থাপন করা যায় ততটি মুক্তা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • নিউক্লিয়াস অপারেশন পদ্ধতি : এই প্রক্রিয়ায় একটি নিউক্লিয়াস হিসেবে বহিঃস্থ টিস্যু যেমন ছোট পুতি, ছোট মুক্তা, মাছের চোখের বল, পাথর কণা ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ঝিনুকের তিনটি স্থান যেমন- পিছনের দিক যেখানে ম্যান্টল বেশ পুরু, পরিপাকতন্ত্রের উপরিভাগে এবং পায়ের মাংসে নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করতে হবে। প্রতিস্থাপনের জন্য একটি ধারালো সূচের সাহায্যে ঝিনুকের দেহে একটি ছোট গর্ত তৈরি করে তাতে নিউক্লিয়াসটি স্থাপন করতে হবে। নিউক্লিয়াসের গায়ে একটি ম্যান্টলের টুকরা স্থাপন করার পর গর্তেও মুখ বন্ধ করে দিতে হবে।
  • ইমেজ মুক্তা অপারেশন পদ্ধতি : ঝিনুকের ম্যান্টলের নিচে একটি ইমেজ প্রবেশ করিয়ে দিলে সেই ইমেজের উপর মুক্তার একটি প্রলেপ পড়ে যা দেখতে খুবই সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মুক্তার প্রলেপযুক্ত এই ইমেজকে মুক্তা বলে। মোম, খোলস, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদি পছন্দ মাফিক ইমেজ তৈরি করে তা প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে নিতে হবে। তারপর একটি পাতলা পাত দিয়ে খোলসের কিছু অংশ থেকে ম্যান্টল আলাদা করে সেখানে ইমেজটি সাবধানে ঢুকিয়ে দিতে হবে। সাবধানে ম্যান্টলের গর্ত থেকে বাতাস ও পানি বের করে দিতে হবে।

 

 অপারেশনকৃত ঝিনুকের চাষ

অপারেশনকৃত ঝিনুক ২-৩ বছর পানিতে চাষ করার পর তাতে মুক্তা তৈরি হয়। পুকুর, নদী, হ্রদে যাতে পরিবেশ ভালো থাকে, দূষণ বা রোগের পাদুর্ভাব নেই এমন জলাশয় মুক্তা চাষের উপযোগী। পুকুরের আয়তন ৫০ শতকের বেশি হতে হবে। পানির গভীরতা ৫-৭ ফুট হতে হবে। মুক্তা চাষের পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল চাষ করা যাবে তবে সিলভার কার্প বা কোনো রাক্ষুসে মাছ চাষ করা যাবে না। এছাড়া নদীর কূলবর্তী এলাকা যেখানে পানির প্রবাহ থাকে সেখানে মুক্তা চাষ করা যায়। পুকুরে সামান্য পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ভালো। মুক্তা চাষের জলাশয়ে প্রতি মাসে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ঝিনুকের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা প্রয়োজন। জলাশয়ের পানির রং হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০ সেমি ঝিনুক চাষের জন্য উপযোগী। এরূপ রং না থাকলে সেখানে দৈনিক ২০০-৩০০ গ্রাম গোবর, ৪-৫ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৩ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।

 জলাশয়ে ঝিনুক স্থাপন

উপরোল্লিখিত পরিবেশে পুকুরে বা নদীতে অপারেশনকৃত ঝিনুক স্থাপন করার জন্য আড়াআড়িভাবে পুকুরে নাইলনের মোটা রশি টানাতে হবে। রশির দুই প্রান্তে বাঁশের খুটির সাথে বেঁধে রশিটিকে ভাসমান রাখতে হবে। এরপর প্রতিটি নেট ব্যাগে ২-৩ টি করে ঝিনুক রেখে ২৫-৩০ সেমি দুরুত্বে ব্যাগটি ঝুলাতে হবে। দুটি রশির মধ্যে দুরত্ব হবে ৪-৫ ফুট।

 

 মুক্তা সংগ্রহ

ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মুক্তা সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সাধারণত দুইটি পদ্ধতিতে ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ করা যায়। জীবিত ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ : ঝিনুকের খোলস খুব সাবধানে ফাঁক করে মুক্তার থলি থেকে পাতলা পাতের সাহায্যে সামান্য চাপ দিয়ে মুক্তা বের করে আনতে হবে। সংগ্রহের পর ঝিনুকটি আবার মুক্তা চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

 আয়

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, একটি ঝিনুকে ১০-১২ টি মুক্তা জন্মে।  প্রতিটি মুক্তার খুচরা মূল্য ৫০ টাকা । প্রতি শতাংশে ৬০ থেকে ১০০ টি ঝিনুক চাষ করা যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি শতাংশে ৮০ টি ঝিনুকে গড়ে ১০ টি করে ৮০০ মুক্তা পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য ৪০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি একরে ৪০ লাখ টাকার মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব।