কৈ মাছ বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবহমানকাল ধরে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাছ হিসেবে পরিচিত। এ মাছটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং কম চর্বিযুক্ত। জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায় বিধায় এ মাছের বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। অতীতে এ মাছটি খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাওড় এবং প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণ, প্রাকৃতিক জলাশয়ে পলিমাটি পড়ে ক্রমশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমে যাওয়া, শিল্পকারখানার বর্জ্য, পৌর ও কৃষিজ আবর্জনার জন্য পানির দূষণ, নির্বিচারে মাছ আহরণ আর সেই সাথে মাছের রোগবালাই বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে এ মাছটির প্রাচুর্যতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল, প্লাবণভূমি ও মোহনায় প্রাকৃতিক বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাছটি ইতোমধ্যে বিপন্ন প্রজাতির মাছ বলে চিহ্নিত হয়েছে। দেশীয় প্রজাতির অত্যন্ত মূল্যবান এ মাছটির বিলুপ্তি রোধকল্পে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি যেমন সুগম হয়েছে তেমনি এ মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পথও উন্মোচিত হয়েছে।
কৈ মাছের বৈশিষ্ট্য
কৈ মাছের কৃত্রিম প্রজনন
ব্রুড মাছের পরিচর্যা: প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে সুস্থ-সবল মাছ সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রুড তৈরি করতে হবে। ব্রুড তৈরির জন্য নিন্মবর্ণিত উপায়ে পুকুর প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা করতে হয়:
প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্তকরণ
প্রজনন ঋতুতে পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নিন্মলিখিত বৈশিষ্টসমূহ পর্যবেক্ষণে সহজে সনাক্ত করা যায়:
স্ত্রী মাছ |
পুরুষ মাছ |
ক. গায়ের রং হালকা বাদামী এবং বক্ষ ও শ্রেণী পাখনা উজ্জ্বল বাদামী বর্ণ ধারণ করে। খ. পেট বেশ ফোলা ও নরম এবং আস্তে চাপ দিলে পরিপক্ক ডিম বেরিয়ে আসে। গ. পেটে হালকা চাপ দিলে জনন ইন্দ্রিয়ের স্ফীতি লক্ষ্য করা যায়।
|
ক. বক্ষ ও শ্রেণী পাখনায় লাল বর্ণ দেখা যায়। খ. পেটে হালকা চাপ দিলে সাদা মিল্ট বেরিয়ে আসে। গ. পুরুষ ও স্ত্রী মাছ সাধারণত আকারে কোনো পার্থক্য নেই। |
কৈ মাছের প্রজননকাল শুরু হয় এপ্রিল মাস হতে এবং অব্যাহত থাকে জুন মাস পর্যন্ত। এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ নিন্মরূপ:
সতর্কতা: হরমোন প্রয়োগকৃত মাছ কোনো অবস্থাতেই বাজারজাত করা ঠিক নয়।
কৈ মাছের নার্সারি
কৈ মাছের রেণু পোনার খাদ্য সরবরাহের তালিকা:
সময়কাল |
রেণুর ওজন |
খাদ্য |
প্রয়োগের নিয়ম |
১-৪ দিন |
১০০ গ্রাম |
৩ টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে |
দিনে তিন বার |
৫-৮ দিন |
১০০ গ্রাম |
৩ টি ডিম ও ৫০ গ্রাম আটার দ্রবণ |
দিনে তিন বার |
৯-১২ দিন |
১০০ গ্রাম |
৩০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে |
দিনে তিন বার |
১৩-১৭ দিন |
১০০ গ্রাম |
৪০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে |
দিনে তিন বার |
১৮-২৩ দিন |
১০০ গ্রাম |
৬০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে |
দিনে তিন বার |
২৪-৩০ দিন |
১০০ গ্রাম |
৭০০ গ্রাম নার্সারি ফিড প্রয়োগ করতে হবে |
দিনে তিন বার |
এভাবে নার্সারি করলে প্রতি কেজি রেণু হতে ২.০-২.৫ লক্ষ পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।
উল্লেখ্য, কৈ মাছের নার্সারি পুকুরে রাতের বেলায় প্রায়ই অক্সিজেনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অক্সিজেনের অভাবের কারণে পোনার ব্যাপক মৃত্যু হতে পারে। এ কারণে রেণু মজুদের প্রথম দিন থেকে ৫ দিন পর্যন্ত রাত্রে অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ক্যামিকেল দ্রব্য ব্যবহার করা আবশ্যক। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী রাতের বেলায় অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ক্যামিকেল ব্যবহার করতে হবে।
কৈ মাছের চাষ
পুকুর প্রস্তুতি:
পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা
পোনা মজুদের দিন থেকে ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক পিলেট খাদ্য মাছের দেহ ওজনের ১৫-৪০% হারে সকাল ও বিকালে পুকুরে ছিটিয়ে সরবরাহ করতে হবে,
আধা নিবিড় পদ্ধতিতে কৈ মাছ চাষ করলে ৪-৫ মাসের মধ্যে ৬০-৭০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এ সময় জাল টেনে এবং পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পদ্ধতিতে ৫-৬ মাসে একর প্রতি ১০০০-২০০০ কেজি কৈ মাছ, ৫০০ কেজি গিফট তেলাপিয়া ও ২৫০-৩০০ কেজি সিলভার কার্প মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
আয়-ব্যয়
এক একর জলাশয়ে ৪ মাসে ১.০-১.২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ১.৫-২.০ লক্ষ টাকা মুনাফা করা সম্ভব।
ব্যবস্থাপনা
অপেক্ষাকৃত ভালো উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিন্মেবর্ণিত বিষয়সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে: