১. ভূমিকা
দারিদ্র্য বিমোচনে প্রাণিসম্পদ ভূমিকা সকল মহলে সমাদূত ও পরীক্ষিত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপ্রাণী, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও অনেক উদ্যোক্তা আধুনিক প্রযুক্তির ও পুঁজির অভাবে ঝরে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের দারিদ্র্য বিমোচন তথা আত্ম-কর্মসংস্থান ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ইহা একটি লাগসই যুগোপযোগী লেয়ার পালন পদ্ধতি।
এই পদ্ধতির আওতায় একজন ক্ষুদ্র খামারি ২০০ টি লেয়ার মুরগি পালন করে তার পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা দৈনন্দিন সাংসারিক খরচাদি ও সন্তান-সন্ততির শিক্ষাসহ যাবতীয় খরচ মিটিয়ে বৎসরে টাকা সঞ্চয় করতে পারবে। তাছাড়া, একজন খামারি তার নিজস্ব পারিবারিক শ্রমকে সঠিক ভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মকর্মে নিয়োজিত থেকে এ দেশের প্রোটিন ঘাটতি পূরণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাই, আত্ম-কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যমোচন এবং প্রাণিজ ঘাটতি পূরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে লেয়ার পালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সংক্ষিপ্ত বিবরণ
লেয়ার পালন পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য নিম্নে বর্ণিত অংগ (Component) গুলি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে হবে:
১.সঠিকভাবে সুফলভোগী/ খামারি নির্বাচন
২.খামারি সংগঠন তৈরি
৩.পারিবারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ
৪. খামারের উপযুক্ত স্থান নির্বাচনে এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে নির্ধারিত ডিজাইনে বায়োসিকিউরিটি রক্ষা মূলক মুরগির ঘর তৈরি
৫. বাচ্চার উপযুক্ত ব্রুডিং
৬.মুরগির সঠিক জাত বা স্ট্রেইন নির্বাচন
৭.গুণগত মান সম্পন্ন সুষম খাদ্য তৈরি এবং সঠিকভাবে ব্যবহার
৮.উপকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা
৯.সংগঠনের মাধ্যমে সকল উপকরণ ক্রয় এবং খামারের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করা
১০.নিয়মিতভাবে সদস্যদের মতবিনিময় সভা করা
১১. সংগঠনের সদস্যদের জন্য আপদকালীন আর্থিক সংস্থান রাখার ব্যবস্থা করা
৩. বাস্তবায়ন কৌশল
৩.১ খামারি নির্বাচন ও সংগঠিতকরণ
বাংলাদেশের যে কোনো এলাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ১০-১২ জন উৎসাহী/আগ্রহী, স্বল্প শিক্ষিত পরিশ্রমী সৎ মহিলা/পুরুষ বা বেকার যুবককে খামারি হিসেবে নির্বাচন করত তাদেরকে সংগটিত করা হয়। তবে নির্বাচিত খামারিদের যাতে লেয়ার খামার স্থাপনের জন্য নিজস্ব জমি থাকে এবং সেই স্থানটি লেয়ার পালনের জন্য অবশ্যই যথোপযোগী হতে হবে। নির্ধারিত খামারিদের সংগঠনের আওতায় আনলে খামারিরা দলগতভাবে খাদ্য, টিকা ও খাদ্য মিশ্রিত করণ প্রভৃতি কাজ মিলেমিশে করতে পারে। তাছাড়া, দলগতভাবে করলে খামারিরা তাদের খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমস্যা সম্পর্কে একে অপরের সাথে মতবিনিময়ের ফলে নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে।
৩.২ নির্বাচিত খামারির পারিবারিক প্রশিক্ষণ
নির্বাচিত খামারিকে লেয়ার পালনের ওপর এক সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই প্রশিক্ষণে লেয়ার পালনের তাত্বিক বিষয়সমূহ যেমন, ঘর তৈরি, লেয়ার বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা, সুষম রেশন ফরমুলেশন, টিকাদান কর্মসূচি, খাদ্য সংরক্ষণ, লেয়ারের বিভিন্ন রোগ ও প্রতিকার, বায়োসিকিউরিটি, আলোক ব্যবস্থাপনা, জীবাণুনাশকের ব্যবহারের গুরুত্ব, রেকর্ড সংরক্ষণে গুরুত্ব, বাজারজাতকরণ এবং খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাবের পাশাপাশি সকল বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যাতে একজন নতুন খামারি “হাতে করে শিখে’’ বাস্তব জ্ঞান লাভ করতে পারে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পরিবারের দুই জন সদস্যকে অবশ্যই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। খামারের সকল প্রয়োজনে পারিবারিক সহযোগিতা নিশ্চিত হবে।
৩.৩ ফলোআপ প্রশিক্ষণ
দুই এক ব্যাচ মুরগি পালনের পর সমস্যাভিত্তিক ফলোআপ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর।
খামারের উপযুক্ত স্থান নির্বাচন এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে নির্ধারিত ডিজাইনে মুরগির বায়োসিকিউরিটি রক্ষামূলক ঘর তৈরি:
৩.৪ খামারের স্থান নির্বাচন
তত্ত্বীয়ভবে পোল্ট্রি খামারের জন্য যে সমস্ত শর্ত পালন করে স্থান নির্বাচন করার কথা তা পুরোপুরি সম্ভব না হলেও নিম্নলিখিত শর্ত পালন পূর্বক স্থান নির্বাচন করা দরকার। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত শর্তসমূহ পালন করা দরকার তা নিম্নরূপ:
১. উঁচু এবং ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ আবাসিক আবাসন হতে একটু দূরে হওয়া ভাল
২. আশপাশে খামার থাকলে তা নিরাপদ দূরত্বে থাকা বাঞ্ছনীয়
৩. লিটার সরিয়ে ফেলার ভালো ব্যবস্থা/সুযোগ থাকা প্রয়োজন
৪. আশপাশে পচা ডোবা ও নর্দমামুক্ত হতে হবে
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে
৬. বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকতে হবে
৭. খামার পরিচালনার জন্য পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট আগ্রহ থাকাতে হবে
৮. বাজারজাতকরণের সুবিধা থাকাতে হবে
৪. বাসস্থান নির্মাণ
ডিমপাড়া মুরগি পালনের ক্ষেত্রে খামারের আকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। একজন ক্ষুদ্র খামারির জন্য ২০০টি মুরগি পালন উপযোগী ঘরের নকশা এবং নির্মাণ নিম্নে দেয়া হলো। ২০০ টি মুরগির জন্য সার্ভিস এরিয়াসহ (৫+২৫)Í১২ বর্গফুট জায়গাই যথেষ্ট। এতে প্রতিটি মুরগির জন্য প্রায় ১.৫২ বর্গফুট জায়গা দেয়া হয়েছে। ঘরটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে সরাসরি প্রবেশ করতে না পারে এবং বায়ু এক পাশ থেকে প্রবেশ করে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এতে বিশুদ্ধ বায়ু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এ্যামোনিয়াসহ বিষাক্ত গ্যাস বিতারিত হয়ে মুরগির জন্য আরামদায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করবে এবং যা লিটার শুষ্ক রাখতে সাহায্য করবে।
৫. ঘরের বর্ণনা
৫.১ মেঝে
মাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালনের জন্য ঘরের নকশা উপরে দেয়া হয়েছে। এলাকাভিত্তিক প্রাপ্ত উপকরণের ভিত্তিতে বাঁশের অথবা সুপারি গাছের ফালি দিয়ে মাঁচা তৈরি করা যায়।মুরগির বিষ্ঠা ভালোভাবে নিচে পড়ে যাওয়ার জন্য এক ফালি থেকে অন্য ফালির দূরত্ব ১ ইঞ্চি রাখা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ৬০ বর্গফুটের একটি সার্ভিস এরিয়া রাখতে হয়েছে, যা খাদ্য, ঔষধ পত্র এবং অন্যান্য পোল্ট্রি উপকরণ রাখতে সাহায্য করবে। মাঁচা ভূমি থেকে সাড়ে তিন ফুট উঁচুতে করা হয়েছে যাতে লিটার পরিষ্কারে সুবিধা হয় এবং লিটার সব সময় শুকনা থাকে।
৫.২ পাশের বেড়া
সার্ভিস এরিয়া ছাড়া অন্য দিকের বেড়াগুলো বাশেঁর চটা দিয়ে ১ বর্গ ইঞ্চি তার জালি তৈরি করা যায় পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করতে পারে। তবে বাশেঁর পরিবর্তে বাজারে যে গ্যালভানাইজড তারের তারজালি পাওয়া যায় তাও ব্যবহার করা যায়।
৫.৩ চালা
স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত সামগ্রী উপকরণ যেমন-ছন, গোলপাতা, বাঁশের চাটাই প্রভৃতি দিয়েই ঘরেরচালা তৈরি করা যায়। তবে ছন এবং গোলপাতা দিয়ে তৈরি চালা পোল্ট্রি পালনের জন্য বিশেষ উপযোগী বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া অপেক্ষকৃত সস্তা ঢেউটিন, পলিথিন প্রভৃতি চালা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে টিন দিয়ে চালা তৈরি করলে অবশ্যই টিনের নিচে তাপ নিরোধক যেমন বাঁশের চাটাই ব্যবহার করতে হবে।
৫.৪ ঘর জীবাণুমুক্তকরণ
সঠিক স্বাস্থ্যবিধি পালন লাভজনক মুরগির খামারের পূর্বশর্ত। তাই ঘর তৈরির পর প্রথম কাজ হচ্ছে ঘর জীবাণুমুক্তকরণ। প্রথমে ঝাড়ু এবং পরে ব্রাশ দিযে ঘসে ধুলাবালি ও ময়লা পরিষ্কার করার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে সম্পূর্ণ ঘর ধুয়ে দিতে হবে। অতপর জীবাণুনাশক দিয়ে সম্পূর্ণ ঘর ভিজিয়ে ১ দিন রেখে দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে বাজারে আনেক জীবাণুনাশক পাওয়া গেলেও ক্লোরেক্স নামক তরল জীবাণুনাশক ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। উৎপাদনকারী ব্যবহারবিধি অনুসারে মিশ্রণ অনুপাতে ১০ লিটার পানির সাথে ৪০ মিলি ক্লোরেক্স মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। নতুবা বাচ্চা অতি সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। ঘরে বাচ্চা সরবরাহের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। প্রথম দিন ঝাড়ু ও পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং দ্বিতীয় দিন ঝাড়ু, ব্রাশ ও পানি দিয়ে পরিষ্কার, তৃতীয় ও চতুর্থ দিনি সকালে জীনাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং সবশেষে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলতে হবে।
৬. বাচ্চা উঠানোর আগে মুরগির ঘর তৈরিকরণ
ধাপসমূহ
১. পরিস্কার পানি দিয়ে মুরগির ঘর স্প্রে করে পরিষ্কার করা।
২. পানির সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ জীবাণুনাশক মিশিয়ে মুরগির ঘর স্প্রের মাধ্যমে জীবাণুনশকরণ। (ক্লোরেক্স-৪০মি.লি/১০ লিটার পানি)।
৩. এয়ার টাইড গরের ক্ষেত্রে ধূমায়িতকরণের মাধ্যমে জীবাণুমুক্তকরণ ভালো
৪. মুরগির ঘরে ক্যানপি এবং চিকগার্ড লাগানো।
৫. ঘরের তাপামাত্রা এবং আর্দ্রতা পরীক্ষাকরণ।
৬. খাবারের পাত্র এবং পানির পাত্র জীবাণুমুক্ত করা।
৭. ঘরে মুরগির বাচ্চা উঠানো।
৭. বাচ্চার উপযুক্ত ব্রুডিং
প্রচলিত বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে অথবা বিএলআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বাঁশের তৈরি চিক ব্রুডার ব্যবহার করেও ব্রুডিং করা যায়। ব্রুডিংকালীন সময়ে তাপমাত্র ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ঋতুভেদে ব্রুডিং সময়কাল পরিবর্তন হতে পারে যেমন, গ্রীষ্মকালে ২-৩ সপ্তাহ আবার শীতকালে ৩-৪ সপ্তাহ ব্রুডিংকরতে হতে পারে। ব্রুডিং- এর সময় যে তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে তা নিম্নে দেয়া হলো।
সপ্তাহ |
তাপমাত্রা (ডিগ্রি ফারেনহাইট) |
১ম |
৯৫ |
২য় |
৯০ |
৩য় |
৮৫ |
৪র্থ |
৮০ |
৫ম |
৭৫ |
৬ষ্ঠ |
৭০ |
প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্রুডিং-এব জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চিকগার্ড স্থাপন। সাধারণত ২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট চিকগার্ড হোভার থেকে ২.০-২.৫ ফুট দূরে স্থাপন করা হয়। চিকগার্ড হিসেবে হার্ডবোর্ড, বাঁশের চাটাই ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। তবে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বাঁশের চাটাই অথবা ফ্রেমের মধ্যে পাতলা চট দিয়েও চিকগার্ড বানানো যায়। অবস্থা এবং সহজ লভ্যতার ওপর ভিত্তি করে চিকগার্ড বানাতে হবে এবং তা স্থাপনের পূর্বে, পূর্বের নিয়মে যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
ব্রুডিং করার সময় ব্রুডারের ভেতরের বাচ্চার অবস্থা দেখে বুঝতে হবে তাপমাত্রা সঠিক আছে কিনা? এ জন্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সাধারণত ব্রুডারের ভেতর বাচ্চার অবস্থান তিনটি অবস্থায় বিরাজ করতে পারে।
৭.১ আরামদায়ক অবস্থা
বাচ্চা ব্রুডারের ভেতরে চাড়ানো ছিটানো অবস্থায় থাকবে। বাচ্চার অবস্থান, আরামদায়ক অবস্থা বিদ্যমান।
৭.২ অতিরিক্ত গরম
এ অবস্থায় বাচ্চা ব্রুডারের ভেতর চিকগার্ডের গায়ের দিকে সরে থাকবে অর্থাৎ চিকগার্ড ঘেঁষে অবস্থান করবে।
অতিরিক্ত ঠান্ডা: এ অবস্থায় বাচ্চা গুলো হোভারের খুব কাছাকাছি চলে এসে গাদাগাদি করবে।
প্রতিকার
অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডায় তাপের উৎসের তাপমাত্রা যথাক্রমে কমিয়ে বা বাড়িয়ে সঠিক তাপমাত্রা সমন্বয় করতে হবে।
৯. বাচ্চার প্রথম খাদ্য
লেয়ার বাচ্চার খামারের পৌঁছানোর পর পরই প্রথম গ্লুকোজ, ওয়াটার সলিউবল ভিটামিন এবং ভিটামিন ‘সি’ মিশ্রিত পানি(প্রতি লিটারে ২৫ গ্রাম গ্লুকোজ, ১ গ্রাম মাল্টিভিটামিন এবং ১ গ্রাম ভিটামিন ‘সি’) চিকগার্ডের পানির পাত্রে সরবরাহ করতে হবে। অতপর চিকগার্ডের ভেতরে বাচ্চা ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে বাচ্চা ছাড়ার পূর্বে বাচ্চার ঠোঁট গ্লুকোজ ও ভিটামিন মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে পানি পান করাতে হবে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বাচ্চা ছাড়ার পর কমপক্ষে ৩ ঘন্টা বা বাচ্চার জন্য তৈরিকৃত খাদ্যে যোগান দেয়া যেতে পারে। তারপর লেয়ার স্টারটার সরবরাহ করা হয়। লেয়ার স্টারটারে শতকরা ১৬-১৭ ভাগ প্রোটিন ২৮০০-২৯০০ কেজি ক্যালরি বিপাকীয় শক্তি (ক্যালরি/কেজি)থাকে প্রথম সপ্তাহে প্রতিটি বাচ্চার জন্য গড়ে ৬-৮ গ্রাম খাবার দরকার হয়।
১০. মুরগির সঠিক জাত স্ট্রেইন নির্বাচন
মুরগির খামারে লাভ ক্ষতির অনেক অংশ নির্ভর করে উপযুক্ত ও সঠিক মুরুগির জাত বা স্ট্রেইন নির্বাচনের ওপর। আবহাওয়া, খাদ্যের গুণগতমান, ঘরের ধরন ও ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে সঠিক জাত বা স্ট্রেইন নির্বাচন করতে হবে। খামারের জন্য এক দিনের বাচ্চা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন নিরোগ বাচ্চা ভালো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
১১. গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য তৈরি এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ
গুণগত মান সম্পন্ন খাদ্য এবং তার সঠিক ব্যবহার মুরগি পালনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি মুরগি পালনে খাদ্যে প্রায় ৬০-৭০ ভাগ খরচ হয়। ভালো খাদ্য তৈরি বা ক্রয় এবং এর সুষ্ঠ ব্যবহার লাভজনক মুরগি পালনে অত্যাবশ্যক ।
১১.১ বাড়ন্ত বাচ্চা পালন
ব্রুডিং শেষে ১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত সময় কালকে সাধারণত বাড়ন্ত অবস্থা বলা হয়। এ সময়টা ডিম পাড়া মুরগির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা বাড়ন্ত অবস্থার ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ ডিম উৎপাদন। বাড়ন্তকালীন সময়ে ঝাঁকের সমতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঝাঁকের সব মুরগিগুলোর দৈহিক ওজন কাছাকাছি না থাকলে সবল বাচ্চার প্রতিযোগিতা করে বেশি খাদ্য খেয়ে ফেলে আর দুর্বল হতে থাকে। তাই সকল বাচ্চার মধ্যে সমতা আনায়নের জন্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাচ্চারদিকে নিবিড় তদারকির বিশেষ প্রয়োজন। সমতা রক্ষার জন্য খাদ্য গ্রহণের স্থান অর্থাৎ খাদ্য পাত্রের সংখ্যা অধিক গুরত্বপূর্ণ। খাবার পাত্র ও পানির পাত্রে সংখ্যা কম হলে বাচ্চার দৈহিক ওজনের সমতা আনয়নে ব্যাঘাত ঘটে। বাংলাদেশে প্রচলিত খাদ্য পাত্রে সাধারণত ১৪টি বা ১৮টি মুরগির একত্রে খাদ্য গ্রহণের স্থান থাকে। তাই মোট মুরগির সংখ্যাকে ১৪ কিংবা ১৮ দিয়ি ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যায় তার পূর্ণ সংখ্যা হিসাব খাদ্য পাত্র স্থাপন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পানির পাত্রের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে। মুরগির বাড়ন্ত অবস্থায় ঠোঁট কাটলে ভালো ফল পাওয়া যায় ঠোঁট না কাটলে প্রতিদিন মুরগির ঘরে শাক সবজি পরিষ্কার করে ঝুলিয়ে রাখলে ঠোকরা ঠুকরির মত বদ অভ্যাস অনেক কমে যাবে তবে লেয়ার মুরগিকে দুই বার ঠোঁট কাটা উত্তম। এক বার ৬-১৪ দিন মধ্যে এবং আর এক বার ১২-১৬ সপ্তাহ বয়সে। কোন কোন সময় তিন বারও ঠোঁট কাটা প্রয়োজন হয়ে থাকে ।
১১.২ প্রি- লেয়ার
সাধারণত ১৮-২০ অথবা ১৮-২২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগিকে প্রি- লেয়ার বলা হয়। এ সময় মুরগির ঝাঁকের গড় ওজন কাঙ্ক্ষি ত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আছে কিনা তা পরিক্ষা করা দরকার। এই সময় বাড়ন্ত রেশনের পরিবর্তে প্রি-লেয়ার রেশন সরবরাহ করা প্রয়োজন। ২০ সপ্তাহ বয়সে ঝাঁকের ওজন লক্ষ্যামাত্রর কাছাকাছি থাকলে দিনের আলোর সাথে অতিরিক্ত আলো সরবরাহের মাধ্যমে উদ্দীপনা দেয়া প্রয়োজন। এ সময় ডিম উৎপাদন শতকরা ৫ ভাগ অতিক্রম করলে প্রি-লেয়ার ফিডের পরিবর্তে লেয়ার ফিড সরবরাহ করতে হবে। পুলেট কালিন সময়ের শুরুতে মুরগির ঘরে ডিম পাড়ার বাক্স বসাতে হবে ।
১১.৩ ডিমপাড়া মুরগি পালন
মুরগির ডিম দেয়ার শুরু করবে তখন থেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো ধরনের বদ অভ্যাস সৃষ্টি হয় কি না যেমন অনেক ক্ষেত্রে মুরগির ডিম ভেঙে ফেলে, মলদ্বার ঠোকরানো অথবা ডিম ভেঙে খাওয়া শুরু করা। এ সমস্ত বদ অভ্যাস যদি দেখা দেয় তবে শীঘ্রই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন কারণে এগুলো হতে পারে এ জন্য প্রথমেই কারন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন এবং অভিজ্ঞ পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞে পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক ডিম পাড়া কালিন সময়ে আলোর প্রদানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গড়ে ১৬ ঘন্টা আলোক প্রদান, আদর্শ ডিম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন । খাদ্য ও পানি সরবরাহ নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সরবরাহ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে ডিম উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই রুটিন মাফিক কাজ, লাভজনক পোল্ট্রির পালনের চাবিকাঠি এ সময় মুরগির ডিমপাড়ার জন্য ডিমপাড়ার বাক্স ঘরের মধ্যে স্থাপন করতে হবে। প্রতি ৪-৫ টি মুরগির জন্য ১ টি ডিম পাড়ার বাক্স বরাদ্দ রাখতে হয়। ডিম পড়া বাক্সর পরিমাপ ১ × ১ × ১.২০ (দৈঘ্য Íপ্রস্থÍ উচ্চতা) ঘনফুট হলেই চলে। মুরগির ঘরের অন্ধকার যুক্তস্থানে যেখানে কম আলো এবং যেখানে মুরগি কম চলাফেরা করে সেই স্থানে মুরগির ডিম পাড়ার বাসা দিতে হবে। ডিম পাড়া বাসায় সাথে পরিচিতির জন্য অন্তত ২ সপ্তাহ আগে থেকেই ডিম পাড়ার বাসা ঘরে স্থাপন কররে হবে।
১২. খাদ্য ব্যবস্থাপনা
খাদ্য প্রস্তুত এবং খাদ্য সংরক্ষণ খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রধান অংশ। খাদ্য উপাদান ক্রয়ের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে এবং এ জন্য খাদ্য সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। খাদ্যের গুণগতমান অবশ্যই ভালো হতে হবে। নিম্ন চারটি রেশনের ফলাফল পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কার্যকারিতা অত্যন্ত ভালো।
স্টারটার রেশন
ক্রমিক নং |
উপাদান |
পরিমান (কেজি) |
১ |
গম |
৩৫ কেজি |
২ |
ভুট্রা |
১৬.৯ কেজি |
৩ |
সয়াবিন |
২৭.০ কেজি |
৪ |
চালের কুঁড়া |
১৪.৮ কেজি |
৫ |
ঝিনুক চূর্ণ |
১.৫ কেজি |
৬ |
ডিসিপি |
১.৫ কেজি |
৭ |
ভিটামিন প্রিমিক্স |
০.২৫ কেজি |
৮ |
লাইসিন |
০.১৫ কেজি |
৯ |
মিথিওনিন |
০.১৫ কেজি |
১০ |
সয়াবিন তেল |
২.৫০ কেজি |
১১ |
খাবার লবণ |
০.২৫ কেজি |
|
মোট |
১০০.০০ কেজি |
পুষ্টি |
|
|
|
প্রোটিন |
২১.৭৪ কেজি |
|
বিপাকীয় শক্তি (কেজিক্যালোরি/কেজি) |
২৯৬০ কেজি/ক্যালোরি |
|
লাইসিন (%) |
১.২২ কেজি |
|
মিথিওনিন (%) |
০.৪৩ কেজি |
|
ক্যালসিয়াম (%) |
১.৫ কেজি |
|
ফসফরাস (%) |
০.৮৬ কেজি |
গ্রোয়ার রেশন
ক্রমিক নং |
উপাদান |
পরিমান (কেজি) |
১ |
গম |
২২ কেজি |
২ |
ভুট্রা |
৩০ কেজি |
৩ |
সয়াবিন |
২৮ কেজি |
৪ |
চালের কুঁড়া |
১৫ কেজি |
৫ |
ঝিনুক চূর্ণ |
১.৫ কেজি |
৬ |
ডিসিপি |
২.৫ কেজি |
৭ |
ভিটামিন প্রিমিক্স |
০.৫ কেজি |
৮ |
লাইসিন |
০.১২৫ কেজি |
৯ |
মিথিওনিন |
০.১২৫ কেজি |
১০ |
খাবার লবণ |
০.২৫ কেজি |
|
মোট |
১০০.০০ কেজি |
পুষ্টি |
|
|
|
|
|
|
প্রেটিন |
১৬.৭৯ কেজি |
|
বিপাকীয় শক্তি (কেজিক্যালোরি/কেজি) |
৩১২৫ কেজি/ক্যালোরি |
|
লাইসিন (%) |
০.৮৫ কেজি |
|
মিথিওনিন (%) |
০.৩৩ কেজি |
|
ক্যালসিয়াম (%) |
১.৫ কেজি |
|
ফসফরাস (%) |
০.৯০ কেজি |
লেয়ার রেশন
ক্রমিক নং |
উপাদান |
পরিমান (কেজি) |
১ |
গম |
১৬ কেজি |
২ |
ভুট্রা |