ভূমিকা
তারাবাইম (Macrognathus aculeatus) মাছটি Mastacembelidae পরিবারের আওতাভূক্ত। বাহারি মাছ (Ornamental) হিসাবে টেংরা, গুলসা, রাণি ও খলিসা মাছের মত এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বাহারি মাছ হিসাবে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য বর্হিবিশ্বে এর চাহিদা অনেক। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রতি বছর আন্তজাতিক বাজারে বাহারি একুরিয়াম মাছ হিসাবে তারাবাইম মাছ রপ্তানি ররে লক্ষ লক্ষ ডলার আয় করে থাকে। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এর গুরুত্ব অনেক। এত আছে মানুষের দেহ গঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রোটিন, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও আয়রন। ফিস প্রোটিন অন্যান্য মাংসের ন্যায় রক্তে কোলেস্টেরল জমতে দেয় না। মাছে উচ্চমানের প্রোটিন ছাড়াও লাইসিন, থিয়োনিন ও ফসফরাস প্রচুর পরিমাণে থাকে যা মানবদেহ গঠন, সুস্থ ও সবল রাখার জন্য অত্যন্ত গুরু্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তারাবাইম একটি বিলুপ্ত প্রায় মাছ। লম্বা, হলুদাভ, সর্পিলাকার এ মাছের লেজের দিকে গোলাকার তারারমত কালো দাগ থাকায় মাছটি তারাবাইম নামে পরিচিত। ভারতের আসামে এটি পিকক ইল, টোরা মাড ইল, টোরা, মাড ইল নামে পরিচিত। তারাবাইম বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ও মায়ানমারে পাওয়া যায়। এ মাছটি দেখতে খুবই সুন্দর, বাহারি, খেলেঅয়াড়ি স্বভাবের কারণে (Playful behavior) এ্যাকুরিয়ামের শোভা বর্ধক মাছ হিসাবে বহুল প্রচলন রয়েছে।
এ মাছটি আবহমান কাল থেকে এ দেশের গ্রামীণ অর্থরীতি ও সমাজে প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় এবং পুষ্টি যোগানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা, পুকুর-দীঘি এবং প্লাবন-ভূমিতে ছোট দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এদেশের সংস্কৃতিতে দেশীয় প্রজাতির মাছ ঐতিহ্যগতভাবে মিশে আছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিরুপ প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর মানুষের অত্যাচার, জুলুমের ফলে আমাদের সমৃদ্ধ মৎস্য ভান্ডার এখন কিংবদন্তিতে রুপ নিতে যাচ্ছে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে জলজ পরিবেশের বিপযয়, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার, ডুবন্ত জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা কমে যাওয়ার কারণেও এখন এ মাছটি বিলুপ্তির পথে।
তারাবাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন
ব্রুড ব্যবস্থাপনা: তারাবাইম মাছের কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে ব্রুড মাছ (মা ও বাবা মাছ) ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোট বড় যে কোন পুকুরেই ব্রুড মাছ লালন করা যেতে পারে। তবে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আয়তনের পুকুরেই লালন করা ভাল।
পুকুর প্রস্তুতি
আলো বাতাস পযাপ্ত আছে এরুপ স্থানে পুকুর নির্বাচন করতে হবে। পুকুর হতে হবে কাদামুক্ত। পুকুরের উপর কো গাছপালা না থাকাই ভাল। মাছ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সে জন্য পুকুরের ভিতরের চারিদিক ঘন বাঁশের বানা দিয়ে বেড়া দিতে হবে। পুকুরের পাড়ে যেন কোন গর্ত বা ছিদ্র না থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। পুকুর পুরাতন হলে তলদেশ কমপক্ষে ১৫ দিন শুকনা অবস্থায় রৌদ্র লাগাতে হবে। প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। শতাংশে ৬/৭ কেজি হারে পচা গোবর সমস্থ পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর পুকুরে বৃষ্টি অথবা পাম্পের সাহায্যে ৪/৫ ফুট আয়রন মুক্ত পানি দিয়ে ভর্তি করতে হবে। পানি দেয়ার পর প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০ গ্রাম পটাশ সার এক সঙ্গে মিশিয়ে পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে সার দেবার পর পানি সবুজ বা বাদামি রং ধারণ করার পর প্রতি শতাংশে ৫০-৮০ টি কমপক্ষে ১ বছর বয়সের ১৫-২৫ সে.মি. সাইজের তারাবাইম মাছ মজুদ করতে ডবে। মাছ মজুদ করার পর সরিষার খৈল, অটোচালের কুড়া, আটারভুষি, ফিসমিল, ভিটামিন প্রি-মিক্স ও ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (২০:৩৩:২৫:২০:১:১) অনুপাতে মিশিয়ে মাছের ওজনের ৪-৫% হারে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ও ভোরে খাবার প্রয়োগ করতে হবে।খাবার মাটির প্লেট অথবা ট্রেতেও দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া বাজারের ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ প্যাকেজ ফিডও দেয়া যেতে পারে।এভাবে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যার মাধ্যমে তারাবাইম (পুরুষ ও স্ত্রী) মাছ ৩-৫ মাসের মধ্যে প্রজননক্ষম ও পরিপক্ক হয়ে থাকে।
তারাবাইম (M. aculeatus) মাছ নিশাচর(Nocturnal feeding habits)।এরা রাতে ও ভোরে খাবার খায়। দিনের বেলায় নিজেদের এরা গর্তে আবর্জনার নিচে ডুবন্ত উদ্ভিদের নিচে লুকিয়ে (hide habits) রাখে। এজন্য এদের আম্যয়ের জন্য পুকুরে মাটির ভাংগা চাড়ি, ছোট ছোট বাঁশের পুল , প্লাস্টিক পাইপ ইত্যাদি দিয়ে রাখতে হবে।
তারাবাইম মাছ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় পুরুষ ও স্ত্রী চেনা কষ্টসাধ্য। তবে একই বয়সের স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছ পুরুষ মাছ অপেক্ষা একটু বড় হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক স্ত্রী মাছের পেট বড় নরম ও ভারি গোলাকার নীলাভ বর্ণের হয়ে থাকে এবং পুরুষ মাছের পেট সমান শক্ত লম্বাটে ও চাপ দিলে বিন্দু বিন্দু সাদা শুক্রানু (Sperm) বের হয়ে থাকে প্রজননের জন্য সাধারণত ১৫-২০ সে.মি. সাইজের অথবা ১৫-২৫ গ্রাম ওজনের মাছ ব্যবহার করাই ভাল।
তারাবাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন
উন্নত ব্রুড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ প্রজননের জন্য পরিপক্ক হলে প্রণোদিত প্রজননের জন্য ২টি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। চাপ পদ্ধতি ও কচুরিপানা ব্যবহারের মাধমে প্রজনন পদ্ধতি।
চাপ পদ্ধতি (Striping method)
প্রথমে ব্রড মাছের পুকুর থেকে পরিপক্ক প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ নির্বাচন পূর্বক হ্যাচারিতে ঝর্ণার সাওয়ারের পানিতে ৮-/১০ ঘন্টা রেখে খাপ খাওয়ানোর (Adaptation) পর প্রথমে স্ত্রী মাছকে পিজি (পিটুইটারি গ্ল্যান্ড) ৪০ মি. গ্রাম/কেজি ডোজ দিয়ে ৬ঘন্টা ব্যবধানে ২য় মাত্রা ৫০ মি. গ্রাম/কেজি প্রয়োগ পূর্বক পুরুষ মাছকে একক মাত্রায় ৪০ মি. গ্রাম/কেজি দিয়ে সিসর্টানে ঝর্ণার নিচে রাখতে হবে। ২য় ডোজের ৭-৮ ঘন্টা পর (২৭০-৩৩০ সে. তাপমাত্রায়) মাছ যখন কোর্টসীপ আচরণে জোড়ায় জোড়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে, আলিঙ্গন করতে থাকবে, তখন স্ত্রী মাছকে নরম টাওয়েল দিয়ে ধরে চাপ পদ্ধতিতে ছোট প্লেটে ডিম সংগ্রহ পূর্বক পুরুষ মাছ হতে একই নিয়মে মুক্রানু বের করে পালকের সাহায্যে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত পূর্বক ট্রেতে ছড়িয়ে দিতে হবে। নিষিক্ত ডিম গুলোকে ট্রেতে রেখে পাইপ লাইনে ফোঁটা ফোঁটা পানি সরবরাহ পূর্বক এরেশন দিয়ে রাখতে হবে। ট্রেতে পানির গভীরতা হবে ১০-১২ সে.মি. িএবং পানি হতে হবে সর্ম্পূণ আয়রন মুক্ত। এভাবে ২০-৩০০ সে.তাপমাত্রায় ৩৬-৪০ ঘন্টা পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। প্রজননের জন্য মে-জুন হচ্ছে উৎকৃষ্ট সময়। তবে তারাবাইমের মে থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পযন্ত প্রজনন মৌসুম।
কচুরিপানায় প্রজনন পদ্ধতি
চাপ পদ্ধতির মত একই নিয়মে পিজি ১ম ও ২য় মাত্রা প্রয়োগ পূর্বক প্রভাবক হিসাবে পরিস্কার কচুরিপানা (cleaned water hyacinth) যুক্ত হাপার পানিতে রেখে ঝর্ণার সাওয়ারে ৮-১০ ঘন্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ার পর পুরুষ মাছ মুক্রানু ছাড়ার (External fertilization) মাধ্যমে নিষিক্ত করে থাকে। এই পদ্ধততিতেও ৩৬-৪০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফোটা শুরু হয়। ডিম ফোটা শেষ হলে কচুরিপানা গুরেঅ হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ৈএই পদ্ধতিতে পোনা মৃত্যু হার কম, স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও বৃদ্ধি হারও (Growth rate) বেশি। তারাবাইমের ডিম আঠালো (Sticky) আঠালো ডিম কচুরিপানার শিখরে (roots) লেগে থাকে। ডিম গুলো দেখতে গোলাকার ও সবুজ রংয়ের হয়ে থাকে।
লার্ভাল অবস্থায় লালন
ডিম্বথলি (Yolksac) সম্পূর্ণ মিশে যাবার পর প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্য হিসাবে সিদ্ধ ডিমের কুসুম, ফিস ফ্ল্যাশ, জুপ্লাম্কটন দিতে হবে। কেবল মাত্র প্লাংকটন দিয়েই রেণু কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। তবে এ অবস্থায় রেণুর দ্রুত বাড়ার জন্য (Rapid growth) টিউবিফেক্স (Tubifex worms) খুবই উপযুক্ত খাদ্য।
এ অবস্থায় রেণু পোনা ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়অ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য ট্রেতে এবং হাপায় রেণু পোনা লালনের ক্ষেত্রে দিনে কমপক্ষে ২ বার মেথিলিন ব্লু ব্যবহার করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যদি এ অবস্থায় ফাংগাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং উপযুক্ত খাদ্যের অভাব হয় তখন পোনা মৃত্যু হার হয় খুব বেশি।
ছোট বেলা থেকেই এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে বিশেষ করে দিনের বেলায়। সে জন্য ভাংগা মাটির চাড়ির টুকরা ট্রেতে ও হাপায় জলজ উদ্ভিদ পটাশ পানিতে ভাল করে ধুয়ে দিয়ে রাখতে হবে।
নার্সারি পুকুর ব্যবস্থাপনা
তারাবাইম চাষের পুকুরে মজুদের আগে নার্সারি পুকুরে লালন করে নেয়া ভাল। নার্সারি পুকুর হবে ৮-১০ শতাংশ। পানির গভীরতা তবে ৩-৪ ফুট। পুকুরের তলদেশ হতে হবে কাদা মুক্ত। পুকুর শুকিয়ে তলদেশে কমপক্ষে ১০-১৫ দিন রৌদ্র লাগিয়ে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের পর শতাংশ প্রতি ৫ কেজি পঁচা গোবর ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর পানি দিয়ে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০ গ্রাম ও পটাশ ১০ গ্রাম একত্রে মিশিযে পানিতে গুলে সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।পুকুরটি ভিতরের দিকে ঘন বাঁশের বানা দিয়ে বেড়া দিতে হবে যাতে পোনা ছিদ্র বা গর্ত দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। এভাবে ৭/৮ দিন পর পানি সবুজ বর্ণ হলে শতাংশ প্রতি ১০ মিলি সুমিথিয়ন প্রয়োগ করে ২৪ ঘন্টা পর রেণু পোনা মজুদ করতে হবে। রেণু পোনা মজুদের পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় ও ভোরে শরীরের ওজনের ২০-২৫% হারে নার্সারি খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। এ অবস্থায় নিয়মিত মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।