১. ভূমিকা:
আমাদের দেশে ভেড়া পালনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে মোট ৩.৮২ মিলিয়ন ভেড়া আছে। জাতীয় আয় ও সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদের মধ্য ভেড়ার স্থান চতুর্থ। ভেড়া উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১২%; যা গরু, ছাগর ও মহিষের তুলনায় অনেক বেশি। ভেড়ার মাংস হালাল ও সুস্বাদু, যা মানুষ খেতে পারে অতএব, ভেড়া পালন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ভেড়ার দুধ স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু, যা মানুষ খেতে পারে। অতএব, ভেড়া পালন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ভেড়ার দুধ স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু পণ্য যেমন পনির, মাখন এবং দই তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। দুধ ও মাংস ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাবারের উৎস। এছাড়াও ভেড়ার লোম দ্বরার উচ্চমানের উল উৎপাদন করে যা পোশাক এবং কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ভেড়ার উলের স্থিতিস্থাপকতা, উষ্ণতা এবং স্থায়িত্বর মতো চমৎকার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এটি শীতের পোশাক, কম্বল তৈরি এবং ম্যাটসহ উন্নতমানের টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভেড়া পালনের প্রধান সুবিধা হচ্ছে এদের খাদ্য খরচ কম। গাছের লতাপাতা খেয়ে থাকে বলে ভেড়া পালনের ব্যয় কম লাগে। ভেড়া গরুর পালের সাথে পালন করা যায। স্বল্প জায়গায় থাকতে পারে। একটি ভেড়া বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার গড়ে ১-২টি করে বাচ্চা দেয়। ফলে খামারের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ভেড়ার বিষ্ঠা দিয়ে উন্নত মানের জৈব সার তৈরি করা যায়। খামার পরিচালনায় লোকবল তুলনামূলকভাবে কম লাগে। ভেড়া ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস ।
২. ভেড়ার জাত:
বাণিজ্যিক খামার স্থাপনে ভালো জাতের ভেড়া নির্বাচন করতে হবে। বিশ্বে কয়েকটি উন্নত ভেড়ার জাত হলো মেরিনো, লিসিস্টার লং উল, টুরকানা, ডরসেট, লিনকন, সিগাই, ডরপার, ইস্ট ফ্রিসিয়ান, হ্যাম্পশায়ার, সাফক ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরনের ভেড়া পাওয়া যায়। যথা- বরেন্দ্র অঞ্চলের ভেড়া, যমুনা অববাহিকা অঞ্চলের ভেড়া, উপকূলীয় এলাকার ভেড়া। বর্তমানে দেশি ভেড়ার পাশাপাশি গাড়ল জাতের ভেড়ার খামারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে। বাণিজ্যিক ভেড়ার খামার স্থাপনের জন্য এলাকাভিত্তিক দেশি উন্নত জাত অথবা সংকর জাতের ভেড়া দিয়ে খামার স্থাপন করা যেতে পারে।
৩. ভেড়ার বাসস্থান:
ভেড়া পালনের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো স্বাস্থ্যকর বাসস্থান। আমাদের দেশে যেসব কারণে ভেড়া মৃত্যু হয় তার অন্যতম কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান। ভেড়ার বসবাসের জন্য এমন জায়গা নির্ধারণ করতে হবে যেখানে আলো বাতাসের পরিমাণ ভালো। তাছাড়া ভেড়ার বাসস্থান তৈরির সময় আমাদের আরও একটি বিষয় খেয়াল রাকা খুব জরুরি আর তাহলো মেঝে কাঁচা বা পাকা যেমনই হোক না কেন সেখানে ভেড়া না রেখে মাচার উপর ভেড়া পালন করা ভালো।
৪. ভেড়ার বাসস্থান নির্মাণ:
৫. ভেড়ার খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
ভেড়া অন্য সকল গৃহপালিত পশুর মতো খাদ্যের উচ্ছৃষ্টাংশ খেয়ে থাকে। শুকনো খড়, গাছের পাতা লতা, সবুজ ঘাস ইত্যাদি খেয়ে থাকে। তাছাড়া ভেড়া খোলা মাঠে সবুজ ঘাস খেতে ভালোবাসে। ভেড়া একটি তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণি। ভেড়া আঁশজাতীয় খাদ্য, লতা-পাতা প্রভৃতিকে সহজেই সাধারণ শর্করাতে পরিণত করতে পারে। ভেড়া সাধারণত চরে খেতে পছন্দ করে এবং ছাগলের মতো কোন গাছের মাথা বা ঘাসের ডগা নয় ঘাসের নিচের অংশ থেকে খাওয়া শুরু করে। তাই ভেড়া পালনে খাদ্য খরচ কম।
৬. ভেড়ার বাচ্চার যত্ন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে ভেড়া পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভেড়ার বাচ্চার অধিক মৃত্যুহার। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রসবকালীন অব্যবস্থাপনা ও পুষ্টিহীনতা প্রধান। বাচ্চা প্রসবের পর পর মা ভেড়ির সাথে বাচ্চাকেও মাঠে নিয়ে যাওয়া। সারাদিন মা ভেড়ির সাথে মাঠে মাঠে ঘুরার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল বাচ্চাতে প্রচুর-ধকল পড়ে এবং মারা যায়। তাই বাচ্চা প্রসবের পর ধকল সহ্য করার সামর্থ্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মা ভেড়ির থেকে কিছুদিন আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতে হবে এবং যেহেতু মা ভেড়ি থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দুধ পাওয়া যায় না সেজন্য দুধের weKí খাওয়াতে হবে। এদের রেশনে আঁশযুক্ত খাদ্যের পরিমাণ দানাদার খাদ্যের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। গর্ভবতী ভেড়ির তুলনায় প্রসূতির খাদ্য তালিকায় অধিক পরিমাণে দানাদার খাদ্য প্রদান করা হয়্ বাচ্চা প্রসবের একমাস পূর্ব থেকে ভেড়ির খাদ্য তালিকায় দৈনিক ২০০-২৫০ গ্রাম হারে দানাদার খাদ্য যোগ করতে হয়।
ভেড়ার দানাদার খাদ্যের সাধারণ মিশ্রণ(%)
খাদ্য উপাদান |
শতকরা হার(%) |
চাল/গম/ভুট্টা ভাঙ্গা |
১০.০ |
গমের ভূষি/আটা/চালের কুঁড়া |
৫০.০ |
খেসারি/মাসকলাই/অন্য ডালের ভূষি |
১৫.০ |
সয়াবিন/তিল/নারিকেল/সরিষার খৈল |
২০.০ |
শুটকি মাছের গুঁড়া/মিট এন্ড বোনমিল/প্রোটিন কনসেনট্রেট |
১.০ |
ডাই-ক্যালসিয়াম ফসফেট |
২.০ |
লবণ |
১.৫ |
ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স |
০.৫ |
এই মিশ্রণে বিপাকীয় শক্তি(মেগাজুল/কেজি) ১০.৮৭%এবং বিপাকীয় প্রোটিন (গ্রাম/কেজি) ৬৬%।
৭.রোগ ব্যবস্থাপনা:
অন্য সব গৃহপালিত পশুর মতো ভেড়ার রোগবালাই হয় না । ভেড়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা। গোলকৃমি, ফিতাকৃমি, কলিজাকৃমি ভেড়াকে আক্রান্ত করে। প্রতি ২/৩ মাস পরপর ভেড়াকে কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। ভেড়ার বাচ্চাকেও কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। ভেড়ার চর্ম রোগ ও বহিঃপরজীবী যেমনঃ উকুন, আঠালি, টিক ইত্যাদির রক্ষাতে বছরে অন্তত দু’বার ভেড়ার পশম কাটতে হবে এবং গোসল করাতে হবে। তবে এন্টরোটক্সিমিয়াত, আমাশায়, ধনুষ্টংকার, ক্ষুরা, একথাইমা, পিপিআর, পাতলা পায়খানা, বাদলা, ফুটরট, হেমোরেজিক সেপ্টিসেমিয়া, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে। সিডিউল অনুযায়ী নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে। এসব রোগ হলে অতি দ্রুত নিকটস্থ পশু হাসপাতালে যোগযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. ভেড়ার প্রজনন ব্যবস্থাপনা:
ভেড়া অন্য সকল প্রাণীর মতো প্রজননশীল। ভেড়ি সাধারণত ৬-৮ মাসে প্রজননের উপযোগী হয়। পুরুষ ভেড়া ৪-৬ সপ্তাহ বয়সে যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। জাতভেদে ভেড়ি যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। ফিনশিপ জাতেরে ভেড়ি ৩-৪ মাস বয়সে এবং মেরিনো ভেড়ি কোন কোন সময় ১৮-২০ মাস বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। ভেড়ার ঋতুচক্র ১৭ দিন পর পর আবর্তিত হয়। গর্ভকাল ৫মাস। ১০-১২টি ভেড়ির জন্য একটি প্রজননক্ষম পাঠাই যথেষ্ঠ। একটি পাঠাকে ১০০-২০০ বারের বেশি প্রজনন করানো ঠিক নয়। এছাড়া অন্তঃপ্রজনন এড়াতে সময়ে সময়ে নিজের পালের পাঠা বাদ দিয়ে অন্য পাল থেকে পাঠা আনতে হবে।
১০-১২টি ভেড়ির জন্য একটি প্রজননক্ষম পাঠাই যথেষ্ঠ। ভেড়ির উপযুক্ত দৈহিক ওজনপ্রাপ্ত না হওয়া পযর্ন্ত পাল দেয়া ঠিক নয়। কম ওজনের ভেড়ি থেকে প্রাপ্ত বাচ্চার মৃত্যুহার বেশি হয় এবং মা ভেড়ি হতে পরবর্তীতে ভালো সার্স পাওয়া যায় না। একটি পাঠাকে ১০০-২০০ বারের বেশি প্রজনন করানো ঠিক নয়। প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পাঠার বাড়তি যত্ন নেয়া প্রয়োজন। প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে অঙ্কুরিত ছোলা এবং দৈনিক ৩৫০-৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
৯. ভেড়ার খামার বাণিজ্যিকভাবে লাভবান করতে পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করতে হবে:
ভেড়ার খামারগুলো সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হতে হবে; পরিবেশসম্মত বাসস্থান তৈরি করা। মাচা পদ্ধতিতে ভেড়া পালন করতে হবে। প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে ভেড়া বের করার পর ভেড়ার পায়খানা এবং প্রসাব ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। ভেড়ার বিষ্ঠা ছোট গর্ত করে তাহার মধ্যে পুঁতে কিছুদিন ফেলে রেখে জৈবসার উৎপাদন করে বিক্রি করা যেতে পারে। ভেড়ার ঘরের নিচে এক বা একাধিক পলিথিন এর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে মূত্র এবং বিষ্ঠা সহজেই অপসারণ করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনে ভেড়ার ঘরের পাশে নালা এবং গর্ত তৈরি করতে হবে যেন প্রসাব বা বর্জ্য পদার্থ নালার মধ্য দিয়ে গর্তে জমা হতে পারে। এতে দুর্গন্ধ ছড়ানো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে; ভেড়াকে অর্আবদ্ধ অবস্থায় রাখতে হবে। যখন ছেড়ে পালন করা হবে তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন ভেড়া প্রতিবেশীর শস্য বা ফসল বা চারা গাছের ক্ষতি না করে; ভাল জাতের ভেড়া দিয়ে খামার শুরু করতে হবে, এক্ষেত্রে প্রাণী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসারে ভাল জাতের ভেড়া ক্রম করতে হবে। নতুন ক্রয়কৃত ভেড়ার খামার প্রবেশের পূর্বে পৃথক ঘর অথবা কোয়ারেন্টাইন সেড রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যেন ন্যূনতম ১৫ দিন এখানে নতুনভাবে ক্রয়কৃত ভেড়াগুলো ch©‡eÿY করা যায়; রোগাক্রান্ত ভেড়াকে আলাদা রাকার জন্য অবশ্যই আইসোলেশন সেড থাকতে হবে। ছোট ভেড়ার বাচ্চা, গর্ভধারণকৃত ভেড়া পৃথক থাকার ব্যবস্থা রাকতে হবে; খামারে ভেড়ার খাদ্য রাকার জায়গা ভেড়ার শেড থেকে দূরে হতে হবে এবং খাদ্যসমূহ শুষ্ক, উঁচু ও পরিষ্কার জায়গায় রাখতে হবে। ভেড়া রোগে মারা গেলে অবশ্যই দূরে কোথাও গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে; খামারে কোন ধরনের রোগ দেখা দিলে নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ অফিসে খবর দিতে হবে; সিডিউল অনুযায়ী ভেড়াকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে; ভেড়া পালনের সম্ভাব্য উপকরণ ও সেবা প্রাপ্তির উৎস সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন: পশুখাদ্য, ঔষধ, টিকা, খামার যন্ত্রপাতি, আর্থিক কারিগরি সহযোগিতা। ঔষধ প্রদান ব্যবস্থাপত্র সংরক্ষণ, ক্রয় ও বিক্রয় সংক্রান্ত তথ্য, খামার উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য যেমন বাচ্চা উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়সমূহের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে; দৈনন্দিন কাজের লিখিত চেকলিস্ট খামারে থাকতে হবে এবং তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে; খামারে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রাণী কল্যাণের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে। খামার শ্রমিকদের অবশ্যই পার্সোনাল হেলথ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং শ্রমিকদের টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা খামার থেকে দূরে হতে হবে। ভেড়ার cwiPhv©i পরে সাবান দিযে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।