খরগোশ পালন

পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন ও ব্যবস্থাপনা

Md.Samsul Alam | ১৩ মে ২০২৪

ভূমিকা:

জনবহুল বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি একটি প্রধান সমস্যা। বিগত বছরগুলোতে দেখা যায় উৎপাদিত প্রাণিজ আমিষ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। কিন্তু মানুষের পুষ্টি চাহিদাপূরণে প্রাণিজ আমিষ যথা: দুধ, ডিম, মাংস ইত্যাদির গুরুত্ব ব্যাপক বা অপরিসীম।  পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণ, আয় বৃদ্ধি এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অন্য প্রাণির তুলনায় খরগোশ সহজেই পালন করা যায়। এর খাদ্য এবং ব্যবস্থাপনা সহজ বিধায় বাড়ির মহিলা ও ছেলে মেয়েরা কাজের ফাঁকে সহজেই খরগোশ পালন করতে পারেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যথা- আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ড, চীন, জাপানসহ অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালন করা হয়। বাংলাদেশে এর প্রতি পালন এবং মাংস এখনো জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। তবে বি, আর, ডি, বি, এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য কিছু বেসরকারি সংস্থা খরগোশ পালনে খামারিদের উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খরগোশ পালন অত্যন্ত লাভজনক। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির যে খরগোশ দেখা যায়, তন্মধ্যে সাদা, কালো, ডোরা, এবং খয়েরি রঙের খরগোশ বেশি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত জাত সমূহের মধ্যে ডার্ক গ্রে (নেটিভ), ফক্স, ডাচ, নিউজিল্যান্ড লাল, নিউজিল্যান্ড সাদা, নিউজিল্যান্ড কালো, বেলজিয়াম সাদা এবং ছিনছিলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

টেবিল ১. বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন জাতের খরগোশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

জাত

উৎপত্তি

প্রাপ্তি স্থান

রঙ

দৈহিক ওজন (বয়স্ক)

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

(১) ডার্ক গ্রে (নেটিভ)

বাংলাদেশ

ঢাকা, যশোর

গাঢ়, ধূসর

২-৩ কেজি

চালাক চতুর এবং ভালো তৃণভোজী

(২) ফক্স

আমেরিকা

কালো এবং অম্রবর্ণ

২.৫-৩.১৭ কেজি

ছোট আকৃতির এবং মাংসল জাত

(৩) ডাচ

নেদারল্যান্ড

ঢাকা

সাদা দাগযুক্ত ধূসর রঙের

১.৮-২.২৫ কেজি

মাংস উন্নতমানের এবং ল্যাব প্রাণী

(৪) নিউজিল্যান্ড লাল

নিউজিল্যান্ড

ঢাকা, যশোর

লালচে সাদা

৩.৬০-৪.৫০ কেজি

মাংস খুবই উন্নতমানের তৃণভোজী এবং তুলনামূলকভাবে বেশি শান্ত

(৫) নিউজিল্যান্ড সাদা

নিউজিল্যান্ড

ঢাকা, যশোর

খুলনা

সাদা

৪.০৫-৫.৪৪ কেজি

মাংস খুবই সুস্বাদু, দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ভালো তৃণভোজী

(৬) নিউজিল্যান্ড কালো

নিউজিল্যান্ড

ঢাকা, যশোর

খুলনা

কালো

৪-৫.৪৪ কেজি

দ্রুত বর্ধনশীল, তৃণভোজী এবং মাংস খুবই সুস্বাদু

(৭) বেলজিয়াম সাদা

বেলজিয়াম

ঢাকা

সাদা

৩.৫২-৪.৭ কেজি

দ্রুত বর্ধনশীল, তৃণভোজী এবং মাংস খুবই সুস্বাদু

(৮) ছিনছিলা

ফ্রান্স

ঢাকা,যশোর

-

২.৫০-২.৯৫ কেজি

অত্যন্ত ভালো মানের মাংস উৎপাদনকারী এবং তৃণভোজী

                        

খরগোশ পালনের সুবিধাসমূহ:

১. এটি দ্রুত বর্ধনশীল প্রাণি।

২. বাচ্চা দেয়ার হার অত্যধিক, এক সাথে ২-৮টি বাচ্চা প্রসব করে।

৩. প্রজনন ক্ষমতা অধিক এবং এক মাস পর পর বাচ্চা প্রদান করে।

৪. খাদ্য দক্ষতা অপেক্ষাকৃত ভালো।

৫. মাংস উৎপাদনে প্রোল্টির পরেই খরগোশের অবস্থান।

৬. অল্প জায়গায় স্বল্প খাদ্যে পারিবারিক পর্যায়ে পালন করা যায়।

৭. অল্প খরচে অধিক উৎপাদন সম্ভব।

৮. খরগোশের মাংস অধিক পুষ্টিমানসম্পন্ন ও উন্নতমানের।

৯. সব ধর্মের লোকই এর মাংস খেতে পারে তাতে কোনো সামাজিক বাধা নেই।

১০. রান্না ঘরের উচ্ছিষ্টাংশ, বাড়ির পাশের ঘাস, লতা-পাতা খেয়ে এর উৎপাদন সম্ভব।

১১. পারিবারিক শ্রমের সফল ব্যবহার করা সম্ভব।

টেবিল: ২. খরগোশের শারীরিক ও বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যাবলি:

গুণাবলি

পর্যবেক্ষণ

মন্তব্য

পায়ুর তাপমাত্রা

গড়ে ৩৯.৫০ সে. রেঞ্জ ৩৮-৪০ ডি. সে. 

জাতের পার্থক্য বিদ্যমান এবং ছোট প্রাণীতে বেশি তাপমাত্রা থাকে।

নাড়ী স্পন্দন

(১৫০-৩০০) বিট/মিনিট

খুব ছোট খরগোশের হৃদস্পন্দন বেশি হয়।

শ্বাস-প্রশ্বাসের হার

৩০-১০০/মি.

প্রাপ্ত বয়সে গড়ে ৫-৫০

দুগ্ধ দান কাল

গড়ে ৪২ দিন

-

বাচ্চা প্রদানের হার/মাদী খরগোশ/বছর

২-১০

সাধারণত দর্শনী জাতগুলোতে কম হয় তবে আভ্যন্তরীণ ফার্মে ব্যবহৃত জাতগুলিতে এর সংখ্যা বেশি হয়।

বাচ্চার সংখ্যা

২-১৪টি

ইহা নির্ভর করে জাত, স্টেইন পার্থক্যের উপর। মাঝারি আকারের প্রদর্শনী স্টকে কম গড়ে ৫-৬টি কিন্তু বাণিজ্যিক জাতে ৮-৯টি

জীবনকাল

৬-১১ বছর

-

পূর্ণতা প্রাপ্তির বয়স

১৬-২৬ দিন

ছোট জাতের পূর্ণতা প্রাপ্তি আগে হয়।

গর্ভধারণ কাল

৩১-৩২ দিন

তবে এটি ২৯-৩৪ দিন হতে পারে।

প্রাপ্ত বয়স্ক ওজক

১-৭.৫ কেজি

তবে খুব কম ক্ষেত্রে ১২ কেজি পযন্ত ওজন হয়।

সেক্স রেশিও

১০০ পুরুষ: ১০২ স্ত্রী খরগোশ

-

 

খরগোশ প্রতিপালনের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

বাসস্থান:

বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালনের জন্য বহুতল বিশিষ্ট খাঁচা এবং মেঝেতে খরগোশ পালন করা যায়। স্বাভাবিকভাবে জাত অনুযায়ী মেঝের আকারে বিভিন্ন ধরনের হয়। সাধারণত প্রতি ৮টি বয়স্ক খরগোশের জন্য (৫ ফিট *২ ফিট) বর্গফুট একটি খাচার প্রয়োজন হয় এবং প্রজননের সময় আলাদা প্রজনন ঘর ব্যবহার করা (১ বর্গফুট/১/২ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য) হয়। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে খরগোশ ছেড়ে পালন করা যায়, তবে বাচ্চা দেয়ার সময় এরা নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে নিজের গায়ে লোম ছিড়ে বাসা তৈরি করে। যদি খাচায় পালন করা হয়, তবে বাচ্চা দেয়ার সময় মের্টানিটি বক্স বা নেট ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক খরগোশের খাঁচার পরিমাপ ও মেটার্নিটি  বক্সের পরিমাণ দেয়া হলো- 

খরগোশের ঘরের/খাচার পরিমাপ: প্রতিটি খরগোশের জন্য খাচার পরিমাপ

দৈর্ঘ্য-৭৫ সে.মি.

প্রস্থ- ৪৫ সে.মি.

এবং উচ্চতা-৩৫ সে.মি.

মেটার্নিটি বক্সের পরিমাপ:

দৈর্ঘ্য-৪০ সে.মি.

প্রস্থ-৩০ সে.মি.

উচ্চতা-২৫ সে.মি.

দরজা-১৫ সে.মি.

খাদ্য: বয়স ও জাত ভেদে খরগোশের খাদ্য গ্রহণ ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়। একটি খরগোশের খাদ্যে রসদে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা নিম্নে দেয়া হলো-

ত্রুড প্রোটিন (সিপি)=১৭% (ভাগ)

আশ (ফাইবার)= ১৪% (ভাগ)

মিনারেল=৭%

বিপাকীয় শক্তি (এমই)= ১১ মেগাজুল/কেজি

খাদ্য গ্রহণ:

১৩০-১৪৫ গ্রাম/দিন (বয়স্ক খরগোশ)

২৫০-৩০০ গ্রাম/দিন (দুধালা খরগোশ)

৯০ গ্রাম/দিন (বাড়ন্ত খরগোশ

খাদ্য উপাদান সমূহ:

সবুজ শাকসবজি

ঋতুভিত্তিক সবজি, পালং শাক, গাজর, মুলা, শসা শাকের উচ্ছিষ্টাংশ, সবুজ ঘাস ইত্যাদি।

দানা খাদ্য:

চাল, গম, ভূট্টা, তৈলবীজ ইত্যাদি তবে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের জন্য মুরগির মত তৈরিকৃত মিশ্রিত খাদ্য  খরগোশের রেশন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রজনন:

খরগোশ সাধারণত ৫-৬ মাস বয়সে প্রথম প্রজননক্ষম হয়, তবে ঋতু এবং পর্যাপ্ত ওজন প্রাপ্তির ওপর এটি অনেকাংশে নির্ভরশীল। গর্ভবতী খরগোশ ২৮-৩৪ দিনের মধ্যে বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চার ওজন খরগোশের শারীরিক ওজনের ওপর নির্ভরশীল এবং এটি সাধারণত দৈহিক ওজনের ২% হয় অর্থাৎ ১.২৫ কেজি (সোয়া কেজি) ওজনের একটি খরগোশের বাচ্চার ওজন হয় ৩০ গ্রাম। খরগোশের দুগ্ধদান কাল সময় ৬-৮ সপ্তাহ এবং উইনিং ওজন হলো ৮০০-১২০০ গ্রাম। খরগোশ প্রতিবারে ২-৮টি বাচ্চা প্রদান করে এবং একবার বাচ্চা দেয়ার ৩ মাস পরেই আবার বাচ্চা দিতে পারে। প্রজননের সময় একটি পুরুষ খরগোশের সাথে ৩-৪টি স্ত্রী খরগোশ রাখা যেতে পারে, তবে গর্ভবতী খরগোশকে পৃথক করে রাখা প্রয়োজন। 

খরগোশের বাচ্চার যত্ন:

খরগোশ ছোট প্রাণী যদিও এটি এক সংগে ৬-৮টি বাচ্চা দেয়, তাই অনেক সময় প্রথম দশ দিন এই বাচ্চাগুলোর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়, যেমন: মা খরগোশ থেকে দুধ খেতে সাহায্য করা, প্রয়োজনে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানো, ভাতের মাড় বা দুধে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। তাছাড়া বাচ্চার ঘরের প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা করা, প্রিডেটর, লাল পিঁপড়া ইত্যাদির হাত থেকে বাচ্চা রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

খরগোশের রোগ-বালাই:

 খরগোশ অতিশয় সুন্দর এবং নরম প্রকৃতির প্রাণী। এটি অত্যধিক পোষ মানে। খরগোশের রোগ তুলনামূলকভাবে কম। খরগোশ পরিচ্ছন্ন জায়গায় থাকতে বেশি পছন্দ করে। এর ঘর সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। ঘরে প্রয়োজনীয় আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঘরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, ধুলাবালি, পোকামাকড়, ইঁদুর, পিঁপড়া ইত্যাদি রোধ করতে হবে। ঘরে ২৯০ সে. এর বেশি তাপমাত্রা থাকলে পুরুষ খরগোশের সাধারণত অনুর্বরতা দেখা যায়। তাছাড়া কক্সিডিওসিস, গলাফুলা, পাস্তরিলোসিস প্রভৃতি কয়েকটি রোগ খরগোশে সাধারণত দেখা দেয়। নিম্নে অসুস্থ খরগোশের কয়েকটি লক্ষণ দেয়া হলো-

১. চোখ, কান খাঁড়া থাকে না।

২. লোম শুষ্ক ও রুক্ষ দেখায়।

৩. পানি খেতে অনীহা প্রকাশ করে।

৪. দৌড়াদৌড়ি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।

৫. শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।

 

খরগোশ প্রতিপালনে ঝুঁকিপূর্ণ দিকসমূহ:

১. উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারজাতকরণে সমস্যা।

২. খরগোশের মাংস সবাই খেতে চায় না।

৩. খরগোশ অসুস্থ হলে বাচানো সম্ভব হয় না।

৪. খরগোশের ইউরিনে ভীষণ গন্ধ থাকে।

৫. বাচ্চার যত্ন বিশেষ করে প্রথম ১০ দিন সতর্কতামূলক অবলম্বন করা প্রয়োজন।

উপসংহার:

বাংলাদেশে খরগোশকে সাধারণত শখের বা পোষা প্রাণী হিসেবে পালন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালন করা হচ্ছে। খরগোশের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু। খরগোশের মাংস প্রোটিন, শক্তি, মিনারেল ইত্যাদির পরিমাণ বেশি এবং ফ্যাট, সোডিয়াম এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম। তাছাড়া গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে খরগোশ পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আয়ের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। খরগোশের মাংস একদিকে যেমন প্রাণিজ আমিষের একটি চমৎকার উৎস হতে পারে অন্যদিকে অভাবগ্রস্থ মহিলা ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের একটি বিরাট উৎস হতে পারে।